জঙ্গিবাদের হিজরতে পাঠিয়ে মা : আব্বু তুমি ভুল পথে আছো, আত্মসমর্পণ করো
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য পাহাড়ে প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে তার মা বলেছেন, ‘আব্বু, যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো। বলতে চাই, তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনও ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবেন।’
আট মাস আগে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান (১৫) নামে একজন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এতোদিন সন্তানের দেখা না পেয়ে হতবিহ্বল মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের মাধ্যমে মাধ্যমে এ আর্জি জানান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে বিমান বাংলাদেশে চাকরি করেছি খণ্ডকালীন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, চরম ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম। এ কারণে আজকে আমার আদরের সন্তান বান্দরবানের পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায় আছে। আমি জানি না, আমার সন্তান বেঁচে আছে কি-না? জানি না আমি কখনো দেখতে পাবো কি-না? এটা আমার মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা। শিক্ষিত মেয়ে হয়েও আমি বুঝতে পারি নি। আমার কোরআন হাদিসের দক্ষতা কম ছিলো। আমি বুঝতে পারি নি সিঠিক কোনটা, ভুল কোনটা। আমাকে মটিভেটেড করা হয়েছে। আমার সন্তান আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকেও (১৫) করা হয়েছে। আমাকে মিসগাইড করা হয়েছে।’
জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সব কিছু আমার কাছে গোপন করা হয়েছিলো। একটা ভুল বিষয়কে আমার সামনে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে সঠিক হিসেবে।
‘আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান আমার একমাত্র আদরের সন্তান অন্যান্য মায়ের মতোই। ও আমার কলিজার টুকরা। মেধাবী ছাত্র, বিনয়ী ছিলো। দুষ্ট বাচ্চার জন্য মায়ের একটু কষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু আমার রিয়াসাদ রাইয়ান ছিলো বিনয়ী, ভদ্র ও খুবই অবিডিয়েন্ট। বিপথে নেওয়ার জন্য আমার ছেলেদের মতো ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। যার শিকার আমি হয়েছি।’
‘গত ৫ নভেম্বর র্যাবের যাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাঁরা খুবই সাবলীলভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বুঝিয়েছেন। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তাঁরা আমাকে বোঝার সুযোগ দিয়েছেন। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য কী, দেশের জন্য তারা কতোটা ভয়ঙ্কর, দেশে যে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, এসব কিছু এখন আমার কাছে পরিষ্কার। একজন মা কখনো চায় না, তাঁর আদরের সন্তান বিপথে চলে যাক। সন্তান যতোই খারাপ হোক না কেনো। মা কখনো তা চায় না। কিন্তু সন্তানসহ আমি মটিভেটেড হয়ে গিয়েছিলাম।’
‘আমার সন্তান চলতি বছরের ১৫ মার্চ ঘর থেকে বেড়িয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে তার শিক্ষক আল আমিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে যোগাযোগ করেন। আল আমিন আমাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিলো। ভদ্র, বিনয়ী আল আমিন খুব ভাল পড়াতো বলে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম। সেই আমাদের এসব করেছে। সেই আমাদের কোরআন হাদিসের রেফান্সে দিয়ে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে বলেছিলো যে, প্রস্তুতি নিতে হবে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, আমি প্রথমে সন্তানকে বলতাম, তোমার এসব শুনতে হবে না, তুমি পড়াশুনা করো।
‘রিয়াসাদ রাইয়ান সায়েন্সের ছাত্র ছিলো। সে ছোটবেলা থেকেই বৃত্তি পাওয়া ছাত্র। শিশু একাডেমি থেকে সে পুরস্কার পেয়েছে। আল আমিন খুবই অল্প সময় কথা বলে আমার সন্তানকে আয়ত্তে নিয়েছে। আমিও ভুল বুঝে মেনে নিয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিলো, আমার সন্তানকে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হবে, ভালো প্রশিক্ষণ, সে সব কিছু জানবে। সে দেখা করতে পারবে, সে যোগাযোগ করতে পারবে। সে বাসায় আসতে পারবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।’
‘আমি দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, আমি যে ভুল করেছি, আমার বুকটা যেভাবে খালি হয়েছে, সেই একই ভুল যেনো কোনও বাবা-মা না করেন। আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়েও শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার পরিবার, সমাজের কাছে প্রকাশ করতে। আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে।’
‘আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলতে চাই, আব্বু… যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো। তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মাকে ভালবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনও ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবেন।’
জঙ্গিবাদে জড়ানো সন্তান রিয়াসাদ রাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে তার মা এমিলি বলেন, তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি খুবই ভয় পেয়ে গেছি, যদি তার কিছু হয়ে যায়। তোমার নানা-নানী সবার অবস্থা খারাপ। তোমার কাকু, আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগলপ্রায়। আমি মা হিসেবে, তোমার বাবার জন্য চরম ব্যর্থতা হবে যদি তুমি বিশৃঙ্খলা করো, নৃশংস কিছু করো। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত করো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছো।’
মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে এমিলি বলেন, ‘আমি শিক্ষিত মা হিসেবে অনুরোধ করছি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সময় দিবেন। সময় দিবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, ভেতরটা জানার চেষ্টা করবেন। ভালোবাসবেন। প্রতিদিন জানবেন। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অবহেলা করবেন না। সে ছিটকে যেতে পারে যে কোনও সময়; তখন আমার মতো বুক ভাসিয়ে আর কোনও লাভ হবে না। সন্তানের মনটা বুঝুন। মা-বাবা যখন সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে, তখন সবকিছু শেয়ার করে, কাছে যেতে পারে। সন্তান হিসেবে অসহায় বোধ করবে না। বিপথে চলে যাবে না। সকল বাবা-মাকে বলছি, সংশোধন হোন, নইলে নিজেও ধ্বংস হয়ে যাবেন, জাতিও ধ্বংস হয়ে যাবে।’
আম্বিয়া বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পাহাড়ে দিন-মাস না খেয়ে কীভাবে আছে। ওরা তো ঘরেই ছিলো, মায়ের বুকে ছিলো। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে। ওরা নিজেও জানে না, কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, ওদের সুযোগ দিন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, মায়ের বুকে ফিরে আসার। ওদের উদ্ধার করুন।’
গত ৩ নভেম্বরের অভিযানে র্যাব ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক সংগঠনের মহিলা শাখা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠিয়েছেন।
র্যাব তথ্য বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে নিজ সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে। এরপর তাকে পরিবারের কাছে রেখে গত ৪ দিন ধরে ডি-রেডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখে।
র্যাব জানায়, ছেলের শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে তিনি ও তার ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথমদিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনটিতে যোগ দেন। পরে আবু বক্কর ২০২২ সালের মার্চ মাসে আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরে নি। অন্যান্য প্রশিক্ষণ শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে আল আমিনের নির্দেশনায় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া রনি (বর্তমানে গ্রেপ্তার) নামে একজনের মাধ্যমে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আবু বক্করকে বান্দরবানে দিয়ে আসে।
আম্বিয়া সুলতানা তার ছেলের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ ও অবস্থান সম্পর্কে জানলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে তা গোপন রাখেন এবং আবু বক্করের বাবা থানায় তাঁর ছেলের নিখোঁজের জিডি করাসহ ছেলের সন্ধানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। আবু বক্কর পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর সন্তানের কোনও খোঁজ-খবর না পেয়ে তিনি চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরে র্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।