ঈদের ছুটিতে ৪ দিনেই আট শর বেশি মানুষ পঙ্গু হাসপাতালে।

ঈদের ছুটিতে ৪ দিনেই আট শর বেশি মানুষ পঙ্গু হাসপাতালে।
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : ইমদাদুল ইসলাম (৩২) পেশায় একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। ঈদের পরদিন গত বুধবার (৪ মে) দুপুরে ঢাকার আশুলিয়ায় বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে তাঁর অটোরিকশা দুমড়েমুচড়ে যায়। আর ইমদাদুলের বাঁ হাত ভেঙেছে, ডান পায়ে একটি রড ঢুকে গেছে। ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চাপ এতো বেশি যে, একটি শয্যা পান নি তিনি। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন ইমদাদুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো, তখন তিনি পঙ্গু হাসপাতালের নিচতলায় জরুরি বিভাগের ওয়ার্ডের সামনের মেঝেতে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। তিনি জানান, মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মিরপুরের দুয়ারীপাড়া এলাকায় থাকেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। দুর্ঘটনার পর এরই মধ্যে তাঁর মা আকলিমা বেগম ২০ হাজার টাকা ধার করেছেন। তিনি কবে কাজে ফিরবেন, আদৌ ফিরতে পারবেন কি না, তা এখনো জানেন না। কীভাবে তাঁর চিকিৎসা চলবে, পরিবার কীভাবে চলবে, সে চিন্তাই সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে। ইমদাদুল ইসলাম জানান, প্রায় পাঁচ বছর ধরে আশুলিয়া-গাজীপুর রুটে অটোরিকশা চালান। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে দুটি বাস আসছিলো। একটি আরেকটির আগে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। একটি বাস এসে তাঁর অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। হাসপাতালের এই ওয়ার্ড ও অস্ত্রোপচারকক্ষের সামনের মেঝেতে ইমদাদুলের মতো আরও অন্তত ২০ জন রোগীর স্থান হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পাঁচজন ছিলেন। তাঁদেরও সবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ঈদের আগের দিন সোমবার থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আট শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। এর একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ, যাঁরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। মূলত ঈদের সময় সড়ক ফাঁকা থাকে। ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ে। গতকাল সন্ধ্যায় পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অবস্থান করার সময়ই ঢাকার উত্তরখান থেকে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় গুরুতর আহত এক শিশুকে নিয়ে আসা হয়। রাকিবুল ইসলাম নামের ৯ বছরের এই শিশু গতকাল দুপুরে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে এখানে দিনে গড়ে ২ শ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তাঁদের একটি অংশ থাকেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। তবে এবার ঈদের আগের দিন (সোমবার) থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন দিন প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী এসেছেন গড়ে ২ শ জনের বেশি। ঈদের পরদিন বুধবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আড়াই শতাধিক রোগী এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৫ জনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। ঢাকার বাইরের রোগী বেশি : ঈদের ছুটিতে হাসপাতালে আসা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের। গতকাল সন্ধ্যায় পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড ও অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনের মেঝেতে দুর্ঘটনায় আহত যে পাঁচজন রোগী ছিলেন, তাঁদের চারজনই আসেন ঢাকার বাইরে থেকে। একজন পাবনার চাটমোহরের চিরইল গ্রামের মো. অনিক (২৫)। তিনি অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে একটি ট্রলিতে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। অনিক গত বৃহস্পতিবার রাতে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ভটভটিতে (তিন চাকার যান) করে চাটমোহরে যাচ্ছিলেন। চাটমোহর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে তাঁদের ভটভটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। অনিকের দুই পা ভেঙে গেছে। দুই পায়েই গতকাল অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। শয্যা না পাওয়ায় সে সময় তাঁর স্থান হয় ট্রলিতে। অনিকের পাশে আরেকটি ট্রলিতে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন মিনারুল ইসলাম নামের এক তরুণ। তিনি গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি রঙের কারখানায় কাজ করেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় গিয়েছিলেন। ঈদের আগের দিন মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পান। প্রথমে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পায়ে অস্ত্রোপচার দরকার হওয়ায় গতকাল তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ডেন্টালের ছাত্র তৌহিদুল হক মা-বাবার সঙ্গে থাকেন ঢাকার বনশ্রীতে। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সল্লাতে গিয়েছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সল্লা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় বেপরোয়া গতির একটি ব্যক্তিগত গাড়ি তাঁর বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। ওইদিনই তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। পরে তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ায় তাঁরও জায়গা হয় জরুরি বিভাগের ওয়ার্ডের সামনের মেঝেতে।