২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ বাড়লো ২৫০০০ কোটি টাকা

২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ বাড়লো ২৫০০০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : নানা ছাড় বন্ড সুবিধা অব্যাহত রেখেও বিদায়ী বছরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমে নি, বরং পুরো বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগেও ছিলো ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিলো ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে বছরের শেষ তিনমাসে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের ঋণ নবায়নের (পুনঃতফসিল) মাধ্যমে নিয়মিত করেছে। ঋণ নবায়ন বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ ছিলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন মন্দমানে পরিণত হওয়া আদায়অযোগ্য ঋণের একটা অংশ অবলোপন করে হিসাবের খাতা থেকে আলাদা করা হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও (আইএমএফ) খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত রয়েছে। সেই শর্ত পরিপালনে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই ব্যাংকগুলো আগে থেকেই খেলাপি ঋণ কমাতে প্রস্তুতি নিয়েছে। তার প্রভাবে কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিলো ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ৩ মাস পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০২৩ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৯৭৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সেখানে ২০২২ সালে বেড়েছিলো ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। মূলত এটা একটা গাণিতিক হিসাব। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সব সময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো।

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। এই পথনকশার মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামানো হবে, যা এখন ৯ শতাংশে রয়েছে। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, যা ডিসেম্বর শেষে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৯৯ ও ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রোডম্যাপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালকদের বিষয়ে নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে, যাতে ঋণশৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়। আর অডিট কমিটির চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্য থেকে থাকতে হবে। এতে করে অডিট কমিটির নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হবে। এমন পদক্ষেপ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। ফলে আগামীতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের বছরের শেষ প্রান্তিকে চাপ দেয়। ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য তাঁদের ঋণ শোধ করতে বলে। ফলে ব্যবসায়ীরা কিছু টাকা দেয়। এতে শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কিছুটা কমে। তবে খেলাপি ঋণ বাড়ার যে প্রবণতা, সেটা এখনো খারাপ পর্যায়ে আছে। কারণ বছর বছর খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিলো ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তিনমাসে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ১৬ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের শেষে তিনমাসে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ৮১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তিনমাসে কমেছে ১০ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে ৮৫ কোটি টাকা কমে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে ছিলো ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। তিনমাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণের স্থিতি রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের ৬৬ হাজার ৪৫৬ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪০ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।