শৌচাগার সমস্যা : পানি পান না করে বের হন ঢাকার ৯০ শতাংশ নারী।

শৌচাগার সমস্যা : পানি পান না করে বের হন ঢাকার ৯০ শতাংশ নারী।
ডন প্রতিবেদন : নিগার সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। এখন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন নিয়মিত। তাঁর বাড়ি ঢাকার অদূরে সাভারে। চাকরির পরীক্ষাসহ নানা কাজে ঢাকায় আসতে হয় মাঝেমধ্যে। এ আসা-যাওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়েন শৌচাগারে যাওয়া নিয়ে। আর সে জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে পানি কম পান করেন বা অনেক সময় একেবারেই করেন না। ঢাকা থেকে সাভারের পথ কম নয়। এরপর ঢাকায় নীলক্ষেত বা কোনো স্থানে কাজের জন্য গেলে ‘প্রকৃতির’ চাপ পেলে তা কষ্টকর হয়ে যায়। ছুটতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বা কোনো বান্ধবীর মেসে। নিগার বলছিলেন, ‘ঢাকায় বেশির ভাগ স্থানে টয়লেট নেই। যেখানে আছে সেখানে যাওয়া এক দুঃস্বপ্নের মতো। চরম নোংরা সেই টয়লেটের কথা মনে এলে আর যেতে ইচ্ছা করে না।’ নিগারের মতো রাজধানীতে যেসব নারী কাজের তাগিদে ঘরের বাইরে বের হন, তাঁদের জন্য শৌচাগারের সুবিধা একেবারেই কম। আর এ সুবিধা না থাকায় বা নোংরা শৌচাগারে যাওয়া এড়াতে ৯০ শতাংশ নারী ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পানি না পান করেই বের হন। নগরে শৌচাগার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ভূমিজ-এর এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, পানি কম পান করা এবং শৌচাগারের অব্যবস্থাপনার জন্য নারীদের ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ঢাকার উত্তর সিটিতে মোট শৌচাগারের সংখ্যা ৬৩। গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর এক হোটেলে বিশ্ব টয়লেট দিবস উপলক্ষে এ তথ্য জানান উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। দক্ষিণের শৌচাগারের সংখ্যা ৬৬। দুই সিটির আনুমানিক জনসংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ। সেই হিসাবে দুই সিটিতে ১ লাখ ৮৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে শৌচাগার আছে। ভূমিজের জরিপে ৩৫০ জন বিভিন্ন বয়সী নারী অংশ নেন। জরিপটি হয় ২০১৮ সালে। ঢাকায় ভূমিজ ১৪টি পাবলিক টয়লেট পরিচালনা করে। এর মধ্যে রাজধানীর গাউছিয়া ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনের দুটি শুধু নারীদের জন্য। ভূমিজের জরিপে যাঁরা অংশ নেন তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। কর্মজীবী ৩০ শতাংশ। এসব নারী ৩ থেকে ১২ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪০–এর মধ্যে। নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে প্রতিদিন বের হন। আর সন্তানকে স্কুলে দেওয়া, কেনাকাটা বা জরুরি কাজে বের হন ২০ শতাংশ। বাইরে গেলে টয়লেট পেলেও করেন না ৯১ শতাংশ নারী। ৯০ শতাংশ নারী বাইরে বের হওয়ার সময় পানি খান না বলেছেন। এসব নারীর মধ্যে ৭৯ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁদের কোনো না কোনো সময় মূত্রনালির সংক্রমণ বা ইউটিআই হয়েছে। ভূমিজের নির্বাহী পরিচালক ফারহানা রশীদ বাংলা কাগজ এবং ডনকে বলেন, ‘জরিপটি তিন বছর আগে হলেও এখনো পরিস্থিতির খুব বেশি যে উন্নতি হয়েছে, তা বলা যায় না। তবে তিন বছর আগের তুলনায় এখন নারীদের পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের হার কিছু বেড়েছে।’ ফারহানা রশীদ জানান, তিন বছর আগে তাঁদের টয়লেটগুলোতে জরিপে দেখা গিয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ নারী পাবলিক টয়লেটে যেতেন। কিন্তু এখন সেখানে যান ১৭ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটিতে ৩১টি টয়লেট পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড। গাবতলী, ফার্মগেটসহ খুব মানসম্পন্ন টয়লেট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়াটারএইডের বাংলাদেশ প্রধান হাসীন জাহান বলেন, টয়লেটের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জরুরি এখন যেসব টয়লেট আছে, সেগুলোর মান উন্নত করা। বেশির ভাগ সরকারি অফিসে সবার ব্যবহারের জন্য যে টয়লেট, তাতে যাওয়া যায় না। এর কারণ হলো, ওই অফিসের প্রধান ব্যক্তিটির কক্ষের পাশেই টয়লেট আছে। তাই তিনি সবার ব্যবহারের জন্য টয়লেটের অবস্থা জানেন না। যদি কোনো অফিসে ব্যক্তিগত টয়লেট বাদ দিয়ে সবার ব্যবহারের জন্য টয়লেট থাকত, তবে বড় কর্তারা এগুলোর তদারকি করতেন। এসবের মান ভালো থাকত।’ যদি কখনো প্রয়োজন হয়ে পড়ে তবে নারীরা মার্কেটে বা রেস্তোরাঁয় যান। জরিপে অংশ নেওয়া নারীরা কিছু সুনির্দিষ্ট জায়গার কথা বলেন, যেসব জায়গায় টয়লেট হওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন। এর মধ্যে আছে মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্টপেজ, রেলস্টেশন, জনসমাগমস্থল ও হাসপাতাল। টয়লেট করতে হলে মোট চারটি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন উত্তরদাতা নারীরা। সেগুলোর প্রথমেই আছে নিরাপত্তা। এর পাশাপাশি আছে মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়, স্যানিটারি প্যাড এবং শিশুদের জন্য সুব্যবস্থা। এভাবে শৌচাগারে যাওয়া এড়াতে পানি কম খাওয়া, টয়লেট চেপে রাখার কারণে অনেক নারী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন বলে মনে করেন পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইউরোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসিনা সাদিয়া খান। তিনি জানান, তাঁর কাছে রোগীদের মধ্যে নারীই বেশি। আর তাঁদের মধ্যে মূত্রনালির সংক্রমণ বা ইউটিআইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। নারীদের জন্য উন্নত টয়লেটের ব্যবস্থা করাটা খুব প্রয়োজন মনে করেন এই চিকিৎসক।