যেভাবে মেধাবীদের দলে ভেড়ায় শিবির ও টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশ্লেষণ
কালাম আঝাদ : মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল- জামায়াতের ছাত্র সংগঠন- শিবির প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে তারা মেধাবীদের টার্গেট করে থাকে। প্রাথমিকে পড়ুয়ারা কিছু না বোঝার আগেই তাদের ব্রেনওয়াশ করার চেষ্টা করে থাকে শিবির। একইসঙ্গে এ ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্য ধর্মাবলম্বী অথচ গরীব- এমন শিক্ষার্থীদেরও টার্গেট করা হয়। এ কারণে শিবিরে অন্য ধর্মাবলম্বী সমর্থকও রয়েছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলছাড়া হওয়ার পর শিবিরের কক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণে নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। যেখানে দেখা যায়, প্রগতিশীল লেবাসধারী অনেকেই রয়েছেন শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ে। তাদের অধিকাংশই শিবিরের সাথী।
ডকুমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রাথমিকের পর মূলত মাধ্যমিকে শিবির ব্রেনওয়াশ ব্যাপক পরিমাণে করে থাকে। আগে তাদের প্রকাশনা দিয়ে মেধাবী, মেধাবী অথচ গরীব অথবা তাদের দলে ভিড়তে আগ্রহী এমন শিক্ষার্থীদেরকে টার্গেট করে প্রচার চালায় শিবির। মাধ্যমিক পাসের পর কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নামে এবং নিজেদের হোস্টেলে রেখে স্বল্পমূল্যে খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা করার নামেও দলে ভেড়ায় শিবির। মূলত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিবির কোরআন-হাদিস পাঠ এবং নামাজ পড়াসহ তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয় এমন সব বই পড়ায় উৎসাহ দিয়ে থাকে শিবির। এক পর্যায়ে এক পাতার একটি কাগজে যতো কিছু লেখা আছে, তার সবকিছুই পালনে বাধ্য করে শিবির। আর এসব বিষয় যে যতো বেশি পালন করে থাকে, তাকে শিবিরের ততো বড় পর্যায়ে নেতা বানানো হয়। এভাবে নিজেদের সংগঠনের প্রয়োজনে একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বই পড়িয়ে ব্রেনওয়াশ করে নিজেদের দলে ভেড়ায় শিবির। পাঠ্য হিসেবে দেওয়া শিবিরের বইয়ের তালিকার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বইগুলোই বেশি। সেসব বইয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ‘গণ্ডগোল’ বা এ ধরনের শব্দ দিয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শিবিরদের পড়ানো হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মূলত হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে। এ কারণে শিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে পাকিস্তানপ্রীতি দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিবিরে ভেড়ানো : উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পার হওয়ার পর যখন একজন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যালে ভর্তি হয়- তখন শিবিরের প্রধান টার্গেট থাকে, ভালো পরিমাণে শিক্ষার্থীকে তাদের মেসে রাখা এবং হলে থাকা তাদের কক্ষগুলোতে রাখা। এক্ষেত্রে দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই শিবিরের কক্ষ রয়েছে বলেই অনুসন্ধানে জানা গেছে। আর একজন শিক্ষার্থীর কাছে যখন হলের কক্ষ সোনার হরিণ হয়ে উঠে, তখন তিনি দেখেন না কোনটা ছাত্রলীগের, কোনটা ছাত্র ইউনিয়নের কিংবা কোনটা শিবিরের কক্ষ। তখন তিনি হলে উঠে যান। আর হলে উঠার পরই মূলত শুরু হয় আসল বিষয়। হলে উঠার কিছুদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি বা দুটি পাতা। যেখানে লেখা থাকে শিক্ষার্থী কোন কোন বই পড়বেন এবং কোরআন-হাদিসের কথাও বলা থাকে তাতে। আর একজন শিক্ষার্থীকে তখন সেসব বই পড়িয়ে ব্রেনওয়াশ করা হয়। তখন সে নিজে থেকেই এক রকম দেশবিরোধী হয়ে উঠে। পাশাপাশি সেখানে পাকিস্তানের পক্ষের বইয়ের সঙ্গে শাসনব্যবস্থা নিয়েও বই থাকায়, তখন সে ভিন্ন রকম শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে থাকে। আর এসব চিন্তায় ঘি ঢেলে দেয় শিবিরের বড় ভাইয়েরা এবং সাবেক শিক্ষার্থীরা।
শিবিরে ক্যাডার : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিবিরের এমন কিছু কক্ষ থাকে, যেটি শিবিরের কক্ষ সবাই জানে, তবে সেসব শিক্ষার্থীরা কোনও নামাজ পড়ে না কিংবা শিবিরের কোনও সভায়ও অংশ নেয় না। বরং তারা ব্যায়াম করে তাদের বডি বানায় এবং মারামারির সময়ে তারাই শিবিরের ক্যাডার হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বাইরে প্রগতিশীল, ভেতরে শিবির : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তত ৭ জন প্রগতিশীল শিক্ষার্থী শিবিরের সাথী পর্যায়ের নেতা। অথচ তারা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের প্রগতিশীলতা প্রকাশ করছেন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনার বিশ্লেষণ : টাঙ্গুয়ার হাওরে বুয়েটের বর্তমান ও সাবেক ৩১ জন এবং ৩ জন এসএসসি পাস শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ধরা পড়ার পরদিন সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেলে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরে তাহেরপুর আমলি আদালতের নির্বাহী হাকিম তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গণমাধ্যমের সর্বশেষ তথ্য হলো, তাদের মধ্যে ৩২ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। এখন এ ঘটনার প্রেক্ষিতে যে কেউ বলতে পারেন, বুয়েটের ৩১ জন শিক্ষার্থী শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত! অথচ সেশনজটের কথা বলে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার প্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে শুধু শিবিরের রাজনীতি নয়, জঙ্গিবাদে জড়িত লোকজনেরও আখড়া হয়ে উঠেছে। কারণ যখন সুস্থধারার বা প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা থাকবে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা ভিন্ন কিছু বেছে নিতে চাইবেন। আর সেই সুযোগটি নিয়েছে শিবির। তবে গ্রেপ্তার হওয়া ৩১ জন শিক্ষার্থীর সকলেই শিবিরের পদবিধারী, এমনটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ শিবির চাইছে, তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য, আর সেজন্য তারা গোপনে ক্যাম্পাসে বৈঠকও করে থাকে। আর টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই ভিন্ন কিছু, কারণ তারা ঠিক শোকের মাসের আগ মুহূর্তেই সেখানে গেছেন। একইসঙ্গে যখন রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত এবং গাড়ি পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটেছে, তখন তারা সেখানে বৈঠক করছেন। তার চেয়েও বড় কথা হলো, সেখানে বুয়েটের সাবেক কিছু শিক্ষার্থীও এসেছিলো। এরপর নির্জন এলাকায় যখন বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পানিভীতি বা অন্যান্য ভীতি থাকার কথা এবং তারা যখন মানুষের সমাগম হবে তখন যাওয়ার কথা, কিন্তু তারা তখন যায় নি। কারণ টাঙ্গুয়ার হাওরে শুক্র ও শনিবার সাধারণত মানুষের সমাগম থাকে এবং অন্য সময় এটি এক রকম নির্জনই বলা যায়। সবমিলিয়ে হিযবুত তাহ্রীরের মতো সংগঠনের উৎপত্তিও এই শিবির থেকে। পাশাপাশি যারাই জঙ্গিবাদে যোগ দিয়েছে, তাদের অধিকাংশই জীবনের কোনও না কোনও সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো। তাহলে শিবিরের বইপত্র একজন শিক্ষার্থীকে কতোটুকু ব্রেনওয়াশ করছে! এ অবস্থায় জামায়াতের নিবন্ধন শুধু বাতিলই নয়, শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যারাই যুক্ত এবং যারা দেশবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত, তাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, কয়েকদিন আগেও পাহাড়ে গিয়ে যারা জঙ্গিবাদে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের অর্থায়নও করেছে জামায়াত নেতারা। এ অবস্থায় নির্বাচনের আগে যাতে দেশে কোনও নাশকতা না করতে পারে, সেজন্য শিবিরের নেতাকর্মী তো বটেই জামায়াতের সকল নেতার বিষয় খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।