জালিয়াতির বড় হোতা জনতার আব্দুছ ছালাম আজাদ!
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ; রাহাতুল রাফি : তিনি যেনো জালিয়াতির বরপুত্র। জালিয়াতি যেনো তাঁর রক্তে। তাইতো যখন শাখা ব্যবস্থাপক ছিলেন, তখন থেকেই করে আসছেন বড় জালিয়াতি। আর এরপরের পদ গ্রহণের পরের কথা তো বলাই বাহুল্য। তাঁর আমলে ব্যাংকটিতে জন্ম নিয়েছে এস আলম, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহর মতো জালিয়াতির ঘটনা। আর কতো শত জালিয়াতি যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকটির নিজস্ব তদন্তে বেরিয়ে আসছে, তা-তো বলাই বাহুল্য। বলছি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের জনতা ব্যাংক থেকে বিদায় নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুছ ছালাম আজাদের কথা। দুই দফায় তিনি ব্যাংকটির এমডি ছিলেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য সোমবার (২৭ নভেম্বর) সকালে আব্দুছ ছালাম আজাদের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও ফোন রিসিভ করেন নি তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এননটেক্স গ্রুপের ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সাবেক এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকেই নড়েচড়ে বসেছে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক পদে থাকার সময় তিনি আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গ্রুপটির ঋণের অনুমোদন, বিতরণ এবং পরিবীক্ষণে সহায়তা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসব বিষয় ওঠে এসেছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মামলা থেকে আব্দুছ ছালামকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণ নতুন করে খুঁজতে শুরু করেছে দুদক। অন্যদিকে এননটেক্স সংক্রান্ত রিপোর্টটি দুদকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে অভিযোগের বিষয়ে দুদকের ব্যাংকিং ও মানি লন্ডারিং শাখার দু’জন পরিচালককে প্রাথমিক অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এননটেক্স গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি : ইউনুস বাদল জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের নামে ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা বের করে নেন। ওই টাকার মধ্যে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তিনি একটি ‘ডামি ফ্যাক্টরি’ করেন। বাকি টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দেন। একটি দেশে তিনি ‘সিসার’ বারও দেন। ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে তার বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি প্রচার করেন। অথচ, তিনি প্রায় বেশিরভাগ অর্থ পাচার করে দিয়ে বেশ ভালোই আছেন। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামেও অভিনব জালিয়াতি করেছে গ্রুপটি।
জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কোম্পানি খুলে জনতা ব্যাংক থেকে এলসির (ঋণপত্র) টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুস বাদল নিজেই । এর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির কোনও সম্পর্ক নেই। এ জালিয়াতিতে সরাসরি সহায়তা করেন জনতা ব্যাংকের সাবেক হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুছ ছালাম আজাদ। এ সংক্রান্ত পরিদর্শন রিপোর্টেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি ওই রিপোর্টটি দুদকেও পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, এননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার ইউনুস বাদল বিএনপির প্রয়াত নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা করেন। নানা ধরনের অপরাধেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গাড়ি চুরির পর নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় গাড়ি চুরি মামলায় তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের বর্তমান ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমানের টিমের হাতে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য ইউনুস বাদলকে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন কেটে দেন।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি : আব্দুছ ছালাম আজাদ যখন জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, তখন এ শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিসমিল্লাহ গ্রুপ ৩৩৩ কোটি টাকার ঋণ হাতিয়ে নিয়েছিলো। যার পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পুরো ঋণটিই এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত। এ ঘটনা প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক বিশদ তদন্ত করে। তাঁদের তদন্তে এ ঘটনার দায়ে আব্দুছ ছালাম আজাদসহ কয়েক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে দুদক ওই শাখার ঘটনায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ৮ জন ও শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আব্দুছ ছালাম আজাদসহ ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ১৫ জনকে আসামি করে ২০১৩ সালে পৃথক দুটি মামলা করে। মামলা দুটির বাদি ছিলেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক যখন কারও বিরুদ্ধে মামলা করে, তখন পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ হাতে রেখেই করে। জনতা ব্যাংকের ওই শাখা ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যখন মামলা হলো, তখনও নিশ্চয়ই সে ধরনের প্রমাণাদি রেখেই মামলা হয়েছিলো। কারণ শাখা ব্যবস্থাপকের সম্মতি ছাড়া ঋণ অনুমোদন সম্ভব ছিলো না। কিন্তু ওই দুটি মামলার চার্জশিট থেকে আব্দুছ ছালাম আজাদের নাম বাদ পড়েছে। বাকি কর্মকর্তারা আছেন আসামির তালিকায়। তবে বিষয়টি আবারও আমলে নিতে চাইছে দুদক।
সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের জনতা ভবন কর্পোরেট শাখায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়। এর মধ্যে শাহরীশ কম্পোজিট টাওয়েলকে ১৮৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং আলফা কম্পোজিট টাওয়েলকে ১৪৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। যা সম্পূর্ণ দেওয়া হয় জালিয়াতির মাধ্যমে। ২০১১ ও ২০১২ সালের মধ্যেই এসব জালিয়াতির বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে। রপ্তানি বিল দেশে না আসায় তার বিপরীতে ফোর্সড লোন তৈরির মতো বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে জনতা ব্যাংকে। যার বড় হোতা ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ।
(দ্বিতীয় পর্ব পড়তে চোখ রাখুন বাঙলার কাগজে)