অগ্রণীর সাবেক এমডি শামস্‌-উলের কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার!

অগ্রণীর সাবেক এমডি শামস্‌-উলের কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও আওয়ার ডন : ‘সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল’ এমনই প্রমাণ মিলেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের বিরুদ্ধে। জামায়াতের এ সমর্থক জাল-জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা ইউরোপসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এমন অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচে অবস্থিত প্রিন্সিপাল শাখা থেকে মোট ঋণের ৩২ দশমিক ২৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছেন ‘তিনি’। এক্ষেত্রে মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম ৫ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাঁকে ‘মিস্টার ফাইভ পার্সেন্ট’ বলেই ডাকতেন অনেকেই। এসবের সঙ্গে এলএটিআর (বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ) ও এলসির (আমদানির ঋণপত্র) মাধ্যমে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি, সুদ মওকুফের মাধ্যমে জালিয়াতি, ঋণ খেলাপি না করার মাধ্যমে জালিয়াতি, সফটওয়্যার কোম্পানির মাধ্যমে জালিয়াতি, নিয়োগে অনিয়ম এবং বদলি ও পদন্নোতিতে বড় অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। যেখানে তিনি বড় অঙ্কের অর্থ নিতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ঋণ বিতরণের বিপরীতে ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে না পারায় ব্যাংকটির গ্রাহকেরা রয়েছেন ঝুঁকিতে। প্রায় ৬ বছর এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অগ্রণী ব্যাংকে সিন্ডিকেট চালুর মাধ্যমে ব্যাংকটিকে এক রকম ধ্বংস করে গেছেন এই মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম। তিনি ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন ব্যক্তির ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর আমলেই এক এলসিতে ৮৯০ কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

এ ব্যাপারে জানার জন্য রোববার (২ অক্টোবর) অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সিইও মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও প্রথমে তা ওয়েটিং পাওয়া যায়। পরে ফোন দেওয়া হলে তিনি কেটে দেন। এরপর খুদে বার্তা পাঠিয়ে ফোন দেওয়া হলে তিনি বাঙলার কাগজ ও ডনের কাছে দাবি করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আসা একটা অভিযোগও সত্য না। আমার ক্যারিয়ারে আমার বিরুদ্ধে কোনও স্পট নেই। হাজার কোটি টাকা পাঠানো কি এতো সোজা! আমি টাকা পাচার করি নি। আমি মাত্র ১৪০০ স্কয়ার ফিটের একটি বাসায় থাকি।’ 

অগ্রণী ব্যাংকের এমডিকে ফোন দেওয়ার পর ০১৯১৩৯৫৪২৮০ নম্বর থেকে এ প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নিউজটির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেদক সম্পূর্ণ অবহিত করার পর আবারও দ্বিতীয়বার ফোন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, আমাদের নিউজ এজেন্সি কতসালে নিবন্ধিত হয়েছে। পরে নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয়সহ বাঙলার কাগজ ও ডনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আমরা বাংলাদেশ, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় ফ্যাট র‌্যাঙ্কে ১ নম্বর অবস্থানে আছি।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, আমরা অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে।  

সূত্র জানায়, সকালে ব্যাংকে এসেই ব্যক্তিগত সহকারীর (পিএস) কাছ থেকে একটি কাগজ নিয়ে তাতে বাম হাতে লিখতেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। মূলত মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম একজন জামায়াতের সমর্থক। তবে তিনি এর আগের কর্মস্থলেই আওয়ামী লীগের ভাবধারায় চলে আসেন। আর অগ্রণী ব্যাংকে আসার পর একজনের সুপারিশে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপন করেন। আর বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করেই পুরোপুরি আওয়ামী লীগার বনে যান মোহাম্মদ শামস্‌-উল। এরপর তাঁর মেয়াদও বাড়ানো হয়। অথচ মেয়াদ বাড়ানোর আগে যে পরিমাণে আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছিলেন তিনি; আর অবসরে যাওয়ার আগে তা বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিলো ৫৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এ ঋণের ৩২ দশমিক ২৮ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে একটিমাত্র শাখা থেকে। সেটি অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচে অবস্থিত প্রিন্সিপাল শাখা। যার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার ঋণ। অভিযোগ রয়েছে, শাখাটিকে ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির প্রায় সব বড় গ্রাহকই প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন।

জানা গেছে, শামস্‌-উল ইসলাম অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০১৬ সালে অগ্রণী ব্যাংকে ২ শ কোটি টাকার বেশি এমন ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিলো ১৩। এসব গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিলো ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯২৯ কোটি টাকা ঋণ ছিলো ওরিয়ন গ্রুপের। কিন্তু গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নেওয়া বড় গ্রাহকের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বড় গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের কেন্দ্রীভূত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার গুণ। ফলে অগ্রণী ব্যাংকের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলার কাগজ ও ডনকে বলেন, যেসব ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা কম, সেসব ঋণ না দেওয়াটাই উচিত। এক্ষেত্রে ঋণ ফেরত আসার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও জোরালোভাবে তদারকি করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র আরও জানায়, গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত, বিতরণকৃত ঋণসহ ব্যবসায়িক পরিধিও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য সুদৃঢ় না হয়ে আরও ভঙ্গুর হয়েছে। ২০২১ সালে সুদ খাতে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৭৪৪ কোটি টাকা। এ সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৯৯২ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতিও রাখতে পারছে না অগ্রণী ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে ৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতি ছিলো ব্যাংকটির।

উল্লেখ করা যেতে পারে, শ্রেণিকৃত বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। যাতে কোনও কারণে টাকা ফেরত না এলেও ওই টাকা থেকে গ্রাহক তথা আমানতকারীর টাকা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে সঠিক পরিমাণে প্রভিশনও সংরক্ষণ করেনি অগ্রণী ব্যাংক। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আমানতকারীদের ঝুঁকি।

সূত্রমতে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার বিপরীতে বড় অংকের কমিশন গ্রহণসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন কেনাকাটা থেকে শুরু করে নানা প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ তিনি নামে-বেনামে দেশে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিদেশে পাচার করেছেন। এর একটি অংশ কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে।

সূত্রমতে, গত বছরের শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিলো ৫৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৬ কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকারও বেশি ঋণ। এসব কোম্পানির একেকটি ২৮৪ কোটি থেকে শুরু করে ২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের সবচেয়ে বড় গ্রাহক ওরিয়ন গ্রুপ। ২০২১ সাল শেষে ওরিয়নের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গিয়েছে ইউনিক গ্রুপের কাছে। গত বছর শেষে এ গ্রুপের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ ছিলো ১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে এ নিট স্পিন লিমিটেড। কোম্পানিটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

ঋণের অন্য বড় গ্রাহকদের মধ্যে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে জাকিয়া গ্রুপের কাছে। 

এ ছাড়া জজ ভূঞা গ্রুপের কাছে ৯২৯ কোটি, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের কাছে ৯ শ কোটি, থার্মেক্স গ্রুপের কাছে ৭৬৯ কোটি, তানাকা গ্রুপের কাছে ৭৩৭ কোটি, ম্যাগপাই গ্রুপের কাছে ৭৩০ কোটি ও নাইস স্পান মিলস লিমিটেডের কাছে ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। এসব গ্রাহক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতা হিসেবে স্বীকৃত।

অগ্রণী ব্যাংকের সরকারি-বেসরকারি বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে আরও রয়েছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (৬৬২ কোটি টাকা), প্যাসিফিক গ্রুপ (৬৫৮ কোটি), যমুনা গ্রুপ (৬৩০ কোটি), প্রাইম গ্রুপ (৬০৮ কোটি), ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন্স লিমিটেড (৫৬৬ কোটি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন (৫৫৩ কোটি), প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেড (৫৩১ কোটি), নোমান গ্রুপ (৫২৭ কোটি), মুন গ্রুপ (৫২১ কোটি), বসুন্ধরা গ্রুপ (৫১৪ কোটি), বিএসআরএম স্টিল (৫১১ কোটি), নোমান উইভিং মিলস লিমিটেড (৫১১ কোটি), বেক্সিমকো গ্রুপ (৫০৯ কোটি), সোনালী গ্রুপ (৫০৩ কোটি), বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড অর্গানাইজেশন (৪৯০ কোটি), আরপিসিএল (৪৬৭ কোটি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (৪৪০ কোটি), সিকদার গ্রুপ (৪৪০ কোটি), অগ্রণী ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (৪০১ কোটি), অ্যারিস্টোক্র্যাট গ্রুপ (৩৯৪ কোটি), নিটল মটরস লিমিটেড (৩৪৩ কোটি), আবদুল মোনেম লিমিটেড (৩০৯ কোটি), লাবিব গ্রুপ (৩০১ কোটি), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ (২৯২ কোটি), সাদ মুসা ফ্যাব্রিকস লিমিটেড (২৮৫ কোটি) ও সিটি গ্রুপ (২৮৪ কোটি টাকা)। 

অগ্রণী ব্যাংকের এ শীর্ষ ৩৬ গ্রাহকের মধ্যে সাতটি কোম্পানি সরকারি খাতের। এসব কোম্পানির কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা।

২০২১ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ গিয়েছে মাত্র ৩৬ গ্রাহকের কাছে। তবে আগের বছর বড় এসব গ্রাহকের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার হার ছিল আরও বেশি। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিলো ৫১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এ ঋণের অর্ধেকের বেশি তথা ২৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকাই পেয়েছিলো মাত্র ৩৬ গ্রাহক।

২০১৬ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম। প্রথম মেয়াদে তিন বছরের দায়িত্ব পালন শেষ হলে ২০১৯ সালে তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে তাঁর।

স্ত্রীসহ শামসুলের অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক : প্রায় ৬ বছর ধরে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা এ এমডির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।

শামস-উল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ ও অবৈধ সুবিধা নিয়ে ঋণ, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগও পেয়েছে সংস্থাটি। অভিযোগ তদন্তে সংস্থাটির পক্ষ থেকে একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য শামস্‌-উল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাসরিন হাসান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দেশের সব ব্যাংকের কাছে দুদক থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।

এ ব্যাপারে মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘আমার ব্যাংকে একটি টাকাও নেই।’

দুদক থেকে ব্যাংকগুলোয় পাঠানো চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, শামস্‌-উল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ ও অবৈধ সুবিধা নিয়ে ঋণ দেওয়াসহ নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। একইসঙ্গে আত্মসাৎকৃত অর্থ বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার ও তার স্ত্রী নাসরিন হাসান চৌধুরী অথবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব থাকলে জানাতে হবে। চলমান, সুপ্ত বা আগে কোনও হিসাব বন্ধ হয়ে থাকলে সে তথ্যও দিতে হবে।

জানা গেছে, প্রথম মেয়াদে তিন বছরের দায়িত্ব পালন শেষ হলে ২০১৯ সালে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও ওই সময় শামস্‌-উল ইসলামকে দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা করা হয়েছিলো।

সূত্র জানায়, দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর শামস্‌-উল ইসলাম আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর সময়েই অলস আমানতের পাহাড় জমে ওঠে ব্যাংকটিতে। যে কোনও উপায়ে আমানত বাড়ানোর কৌশল নিতে গিয়ে ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়। তবে অতিরিক্ত এ আমানত শেষ পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বড় লোকসানের মুখে চলে যায় ব্যাংকটি। আমানত লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার পর ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত নেমে আসে ৫০ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় আগ্রাসী বিনিয়োগ করে এডি রেশিও বাড়ানোর উদ্যোগ নেন শামস্‌-উল ইসলাম। উদ্যোগী হন দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপকে শত শত কোটি টাকার ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়েও। যাতে নেন শত শত কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য বলছে, শামস্‌-উল-ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পর্যন্ত ব্যাংকটি সিন্ডিকেশন ঋণের আওতায় ২৫টি বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। সবমিলিয়ে অগ্রণী ব্যাংক এখন পর্যন্ত ৯৭টি সিন্ডিকেশন ঋণের অনুমোদন করেছে। এসব ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে শামস-উল ইসলাম বড় ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা বাঙলার কাগজ ও ডনকে জানান, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার বিপরীতে বড় অংকের কমিশন গ্রহণসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আছে। 

সফটওয়্যার কোম্পানির মাধ্যমে জালিয়াতি : দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় জার্মান কোম্পানি টেমিনসের সফটওয়্যার (কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার টি-২৪) ব্যবহার করে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। টেমিনসের পক্ষে লোকাল এজেন্ট হিসেবে চুক্তি ও সফটওয়্যারের যাবতীয় সেবা দিয়ে থাকে ঢাকার কোম্পানি ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড। কিন্তু সফটওয়্যার আপগ্রেড কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করেই কোটি কোটি টাকা নিয়ে যায় ফ্লোরা টেলিকম। যার মাধ্যমে মূলত অর্থ পাচার করেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

জানা গেছে, বাজার দর থেকে তিনগুণ বেশি ফি আদায়, সেবা না দিয়ে বিল নেওয়া, অর্থ পাচার- সবই করেছে ফ্লোরা টেলিকম। কোম্পানিটি অগ্রণী ব্যাংকের থেকে যে টাকা পায়, তা আবার কমিয়ে দেখায় চুক্তির প্রকৃত অংশীদার টেমিনসকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সফটওয়্যার চুক্তির আড়ালে অগ্রণী ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

জানা গেছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে ফ্লোরার জালিয়াতির বিষয়গুলো জানাজানি হওয়া সত্ত্বেও লোক দেখানো ছাড়া কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এজন্য অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম দায়ী বলে ইঙ্গিত করেছেন ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে, নিয়মিত মাশোয়ারা এবং বিদেশে টাকা পাচারের সুবিধা পেয়ে তিনি ফ্লোরা টেলিকমের নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে চুপ থেকেছেন। 

সূত্র আরও জানায়, প্রয়োজনীয় সেবা না দিয়ে জালিয়াতিপূর্ণ হিসাবের মাধ্যমে ২০১৮ সালে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে চুক্তি নবায়ন করে ফ্লোরা। জার্মান কোম্পানি টেমিনসের কাছেও প্রকৃত অর্থের পরিমাণ গোপন করা হয়। এজন্য অগ্রণী ব্যাংকের একজন উপ-পরিচালকের সাক্ষরও জাল করে। বিষয়টি ধরা পড়ে যাওয়ার পর ফ্লোরার এজেন্টশিপ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় টেমিনস। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা পারে নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না মানায় জরিমানা, জরিমানা মওকুফের আবেদন নাকচ বাংলাদেশ ব্যাংকের : সিআইবি (ঋণ খেলাপি তথ্য সংক্রান্ত ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্টে গ্রাহকের খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে অগ্রণী ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই জরিমানা মওকুফের আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪২৩তম বোর্ড সভায় নাকচ করা হয়েছে। পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংকে ডলি কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে সংগঠিত অনিয়মের জরিমানা পুনর্বিবেচনার আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত পহেলা আগস্ট অনুষ্ঠিত আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার বোর্ড সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালকেরা।

সূত্রমতে, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ডলি কনস্ট্রাকশনের অনিয়ম করে নেওয়া ঋণের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নির্দেশনার ১০ মাস পার হলেও কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ব্যাংককে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মোট ৩২৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার দুটি ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ডলি কনস্ট্রাকশন ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১৪০ কোটি ১৩ লাখ টাকা তুলেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে এই পরিমাণ টাকা তুলতে কোম্পানিটির অন্তত ২৮০ কোটি ২৬ লাখ টাকা বা ওয়ার্ক অর্ডার দুটির ৮৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ করার কথা। তবে ওই সময় পর্যন্ত বাস্তবে ডলি কনস্ট্রাকশন শেষ করেছিলো মাত্র ৩৫ শতাংশ।

অর্থাৎ, কোম্পানিটি ১১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কাজ শেষ করেই অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১৪০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, এই পরিমাণ কাজের বিপরীতে ডলি কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৫৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা তুলতে পারে। সে হিসাবে, কোম্পানিটি অনিয়ম করে ব্যাংক থেকে ৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত তুলে নিয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। ১১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কাজ শেষ করার বিল ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা জমা দিয়েছে মাত্র ৫১ কোটি ৬ লাখ টাকার। বাকি ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বিলের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কিছুই জানায় নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়ার্ক অর্ডার দুটির মেয়াদ ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল শেষ হয়েছে। সেইসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বর্ধিত মেয়াদও ফুরিয়েছে ২০২১ সালের ৬ জুন। এসব সময়সীমা শেষ হলেও ব্যাংকটি থেকে নেওয়া ১০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ এখনো পরিশোধ করে নি ডলি কনস্ট্রাকশন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমান্ত নদী তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় এক ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ১ শ কোটি টাকা ওভারড্রাফট সীমা অনুমোদন করেছিলো অগ্রণী ব্যাংক। তবে কোম্পানিটি ওই ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে টাকা না তুলে অন্য আরেকটি ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে এই টাকা তুলেছে। নিয়ম অনুযায়ী এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।

এসব অনিয়ম তুলে ধরে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট অগ্রণী ব্যাংককে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন এ আদেশ না মানায় চলতি বছরের ২০ এপ্রিল কোম্পানী আইন অনুযায়ী ‘ব্যাংকের বিরুদ্ধে কেনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না’ জানতে অগ্রণী ব্যাংককে আরেকটি চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে চিঠিতে ৭ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

অথচ ২ মাস পার হলেও অগ্রণী ব্যাংক এসব চিঠির কোনও জবাবই দেয় নি। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্যাংকটিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৩ জুন ইস্যু করা জরিমানার এই চিঠিতে ইস্যুর তারিখ থেকে পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের ‘সাধারণ হিসাব- প্রধান কার্যালয়’- এ জমা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করার জন্য অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জমা না করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে খোলা অগ্রণী ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে টাকা কেটে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাধারণত জালিয়াতি বা অনিয়মের প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও ব্যাংককে জরিমানা করা ব্যাংকিং খাতে একটি নেতিবাচক নির্দেশক হিসেবে পরিগণিত হয়।

এক এলসিতেই জালিয়াতি ৮৯০ কোটি টাকা! : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট বা আমদানির ঋণপত্র) কমিশন বাবদ প্রতি ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ চার্জ নিতে পারে ব্যাংক। সর্বোচ্চ এ হার নির্ধারিত থাকলেও সরকারি প্রকল্পের আমদানিতে কখনও বিনা কমিশন কিংবা নামমাত্র কমিশনে এলসি খোলে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাবমেরিন বেস নির্মাণ প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংক ঘটিয়েছে উল্টো কাণ্ড। ৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকার এলসির বিপরীতে কমিশনের নামে শুধু অতিরিক্ত কেটে নিচ্ছে ৮৯০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে পাঁচ বছরে কাটা হবে ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে দুই কিস্তিতে ৬৫৩ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংক। এখন তৃতীয় কিস্তির টাকা নেওয়ার সময় আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চীনের পলিটেকনোলজিস থেকে সরকারি ওই প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির জন্য অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় ১০ বছর মেয়াদি এলসি খোলা হয় ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর। চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুসারে এলসি মূল্য ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। প্রতি কিস্তি পরিশোধের পর কমিশনের পরিমাণ কমার কথা। সে অনুযায়ী অগ্রণী ব্যাংক সর্বোচ্চ কমিশন নিতে পারে ৭৪৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অথচ ব্যাংকটি পুরো এলসির ওপর ১০ বছরে ৪১ ত্রৈমাসিক হিসাব করেছে। এলসি মূল্য কমার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে মূল এলসির ওপর প্রতি ত্রৈমাসিকে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ হারে কমিশন হিসাব করে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ধার্য করেছে। শুধু তাই নয়, চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির আলোকে প্রথম কিস্তি পরিশোধের ১০৮ মাসের মধ্যে দশম কিস্তি দিতে হবে। প্রথম কিস্তি পরিশোধ হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে অনুযায়ী এলসির মেয়াদ হওয়ার কথা ৯ বছর। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক এলসির মেয়াদ চার ত্রৈমাসিক বেশি নির্ধারণ করেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকটি সর্বোচ্চ হারের অতিরিক্ত কমিশন ধার্য করেছে ৮৮৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ কিস্তি পরিশোধের পর এলসির কোনও কার্যক্রম থাকে না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এলসি খোলা হয়। ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করা হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হয়। এর মানে ১০ কিস্তি পরিশোধ হবে ২০২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার এলসির মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণ করা হলেও সব সরঞ্জাম আসবে পাঁচ বছরে। অগ্রণী ব্যাংকের দাবির আলোকে পুরো কমিশনের টাকা পাঁচ বছরে পাঁচটি কিস্তিতে পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে যা নিচ্ছে ব্যাংক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা এরই মধ্যে নিয়ে গেছে।

এখন ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা চেয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে আবেদন করে অগ্রণী ব্যাংক। এ পর্যায়ে বাড়তি কমিশন নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ায় তা আটকে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এলসির মাধ্যমে ব্যাংক আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধের দায় তথা ঝুঁকি নেয়। প্রতিটি কিস্তি পরিশোধের পর ঝুঁকি কমে বিধায় কমিশনও কমবে। প্রতি কিস্তিতে পরিশোধিত অংশ বাদ দিয়ে কমিশন হিসাব হবে। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা রানডাউন ভ্যালু হিসেবে বিবেচিত। অগ্রণী ব্যাংকের শাখার বিবরণীতেও এ পদ্ধতিতে দায় হিসাব করা হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিডিউল অব চার্জেস নীতিমালায় এলসির বিপরীতে প্রতি ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ হারে কমিশন নেওয়ার বিধান রয়েছে। এলসি কমিশনের সর্বোচ্চ এ হার নির্ধারিত থাকলেও সাধারণভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে তা নির্ধারিত হয়। নৌবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে দরকষাকষির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ফলে রানডাউন ভ্যালু বিবেচনায় প্রতি কিস্তিতে ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৪৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা নিতে পারে। এ হিসাবে প্রথম দুই কিস্তিতে ২৯৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও ব্যাংকটির অযৌক্তিক দাবি অনুযায়ী, দুই কিস্তিতে ৬৫৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। পুরো অর্থ পরিশোধ না হওয়ায় পরবর্তী ৩ কিস্তিতে অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয় করতে হবে। সবমিলিয়ে অগ্রণী ব্যাংক শেষ কিস্তিতে গিয়ে ৯০ কোটি ৫৬ লাখ নিতে পারবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের পর্যবেক্ষণে অতিরিক্ত কমিশন কাটার বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে মতামতের জন্য পাঠানো হয় ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে। এ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, এলসিটি দীর্ঘমেয়াদি এবং মূল্যমান ৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। ফলে সর্বোচ্চ হারে কমিশন নির্ধারণ কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। সরকারি অন্য যেসব এলসি কমিশন দরকষাকষির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস এ ক্ষেত্রেও কমিশন নির্ধারণ করতে পারে। আর একাধিক কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য এলসির ক্ষেত্রে প্রতিটি কিস্তি পরিশোধের পর সম্পূর্ণ পরিমাণের ওপর কমিশন নির্ধারণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা শেষে নিয়ম মাফিক কমিশন হার নির্ধারণের নির্দেশনা দিয়ে গত এপ্রিলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠি পাওয়ার ১০ কর্মদিবসের মধ্যে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আলোকে এলসির মেয়াদ হিসাব করে পুনরায় কমিশন দাবির আবেদন করতে বলা হয়। ব্যাংকের কাছ থেকে যথাসময়ে জবাব না পেলে নিয়ম অনুযায়ী একতরফা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে। জবাব দেওয়ার জন্য দুই মাস সময় নেয় ব্যাংক। সে অনুযায়ী, সম্প্রতি একটি জবাব দিয়ে নিজেদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছে অগ্রণী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, সরকারি এলসিতে এভাবে সর্বোচ্চ হারে কমিশন আরোপ অনৈতিক। সেখানে সর্বোচ্চ হারে কমিশন আরোপেই সীমাবদ্ধ না থেকে পরিশোধ হওয়া অংশের ওপরও প্রতি ত্রৈমাসিকে কমিশন আরোপ করেছে। ব্যাংকিং নিয়মে এর কোনও সুযোগ নেই। ফলে বাড়তি নেওয়া সার্ভিস চার্জ এখন সমন্বয় করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি প্রকল্পের এলসি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে খোলার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে কম কমিশন দেওয়া। এর বড় উদাহরণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। টাকার অংকে দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প নির্মাণে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে খোলা এলসির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই এলসির বিপরীতে এখনও এক টাকাও কমিশন পায় নি সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির দাবির প্রেক্ষিতে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের তরফ থেকে ২০ কোটি টাকা কমিশন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনও এক টাকাও পায় নি ব্যাংকটি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া রাশিয়া থেকে এ আমদানিতে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্টরা এমনটিই দাবি করেছেন।

মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতি থেকে শুরু করে অন্যান্য কারণে তাঁর কর্মদিবসের শেষদিনে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।