রাজশাহীতে আরডিএ’র বড় সব প্রকল্পেই চলছে হরিলুট!

রাজশাহীতে আরডিএ’র বড় সব প্রকল্পেই চলছে হরিলুট!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ; লিয়াকত হোসেন, রাজশাহী : রাজশাহীতে সর্বোচ্চ বাজেটের কাজ চলমান রয়েছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অধীনে। সরকারের এসব উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে- জমি অধিগ্রহণ, একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর চত্বর, শহিদ ক্যাপ্টেন মনসুর রহমান পার্ক সংস্কার, ফ্লাইওভারের সঙ্গে নাটোর রোড (রুয়েট) হতে রাজশাহী বাইপাস পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ কাজ।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, বড় বাজেটের এসব কাজের শুরু থেকেই নেওয়া হয়েছে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয়। এসব কাজে প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে সরকারের সঙ্গে প্রতারণা। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে চলমান কাজে একাধিকবার প্রকল্প সংশোধন করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব টাকা পকেটে ভরেছে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৭ জুন নাটোর রোড থেকে (রুয়েট) রাজশাহীর বাইপাস পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদিত হয়। ওই সভায় ১২ দশমিক ১৭৭১ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব জমি অধিগ্রহণে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৭ কোটি ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। কিন্তু আরডিএ কর্তৃপক্ষ মাত্র দশমিক ৮২৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। যাতে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ টাকা। অবশিষ্ট থাকে ১৭ কোটি ৩৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা। মূলত এখান থেকেই দুর্নীতির শুরু। পরে রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে একের পর প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। গত ৫ বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্প সমাপ্ত হলেও কাগজপত্র জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয় নি।

গত ২৭ নভেম্বর রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক অনিয়মের বিষয়টি উল্লেখ করে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে আরডিএ চেয়ারম্যানকে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের নয়ছয় হয়েছে। অতিরিক্ত টাকা কোন কোন খাতে খরচ হয়েছে, তার কোনও কাগজপত্র নেই। মূলকথা অবিশিষ্ট টাকা কোথায়, তার কোনও হদিসই নেই।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন ৬ দশমিক ১২ হেক্টর (১৫ দশমিক ১১৬৪ একর) ও বাজেট অনুমোদন ২২ কোটি ৫৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ০৪/১৩-১৪ নং এলএ অধিগ্রহণ করা হয় ৪ দশমিক ২৩২৫ একর ভূমি। এবং ব্যয় হয় ১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৪৫ হাজার ৯২ টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোডে ২৩ কোটি ৯২ লাখ ৫৪ হাজার ৯ শ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করা হয়, যার প্রশাসনিক কোনও অনুমোদনপত্র পাওয়া যায় নি। এই প্রকল্পের কার্যক্রম ৫ বছর পূর্বে সমাপ্ত হয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে পূর্বে অধিগ্রহণকৃত জমি রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুকূলে প্রশাসনিক অনুমোদনভুক্ত জমির সঙ্গে আরডিএ কর্তৃক প্রস্তাবিত জমির তফসিলে গড়মিল পরিলক্ষিত হয়।

নাটোর রোড (রুয়েট) হতে রাজশাহী বাইপাস সড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের অবশিষ্ট ২৩ কোটি ৯২ লাখ ৫৪ হাজার ৯০৭ টাকা সমন্বয়/ফেরত প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, সংশোধিত প্রকল্পের জন্য ৫৬ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকার বাজেট অনুমোদন রয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত টাকার কোনও কাগজপত্র নেই। বাজেট বরাদ্দ থাকার পরেও ০৪/১৩-১৪ নং এলএ কেসে অতিরিক্ত জমাকৃত অর্থ হতে সমন্বয়/ফেরত প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ অনুযায়ী অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণের প্রয়োজনীয় অর্থ সঙ্কুলানের ব্যবস্থা ও বিধি মোতাবেক জমা প্রদান করা প্রত্যাশী সংস্থা হিসেবে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত। অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয়/ফেরত বিধি মোতাবেক বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের আওতাভুক্ত। জনস্বার্থে প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য প্রত্যাশী সংস্থা কর্তৃক বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সুরাহা/সমঝোতা শেষেই শুধু এ কার্যালয়ের পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অসঙ্গতি রেখেই বর্তমানেও কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

নাটোর রোড (রুয়েট ) হতে রাজশাহী বাইপাস রোড পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রথম সংশোধিত প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন ১২ দশমিক ১৭৭১ একর। যার বাজেট বরাদ্দ ২৭ কোটি ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। অথচ অধিগ্রহণ করা হয় দশমিক ৮২৮৮ একর এবং ব্যয় হয় ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ টাকা। এখানে অবশিষ্ট ১৭ কোটি ৩৬ লাখ ২৬ হাজার ২২৯ টাকা থাকার পরেও ০৪/১৩-১৪ নং এলএ কেসের (প্রায় ৮ বছর পূর্বের) অতিরিক্ত প্রায় ১৭ কোটি টাকা কীভাবে খরচ হয়েছে, তার কোনও কাগজপত্র নেই।

নাটোর রোড (রুয়েট) হতে রাজশাহী বাইপাস সড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্প রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ দশমিক ২৭৬ হেক্টর অর্থাৎ (১৩ দশমিক শূন্য ৩১৭২ একর) জমি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরের জন্য অলাদা প্রকল্প ও ৫৬ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বাজেট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। ১৩ দশমিক শূন্য ৩১৭২ একর জমির প্রশাসনিক অনুমোদন থাকলেও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দশমিক ৩৭১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছে। এখানেও প্রায় ১৩ একর ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের সমপরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে ৩ দশমিক ১৮১০ একর অধিগৃহীত জমি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরের জন্য আলাদা প্রকল্প ও বাজেট না নিয়ে ৮ বছর পূর্বের এলএ কেসে অতিরিক্ত জমাকৃত টাকা হতে সমন্বয়ের অনুরোধ জানানো হয়।

আরডিএ কর্তৃপক্ষের প্রেরিত পত্রের ফরোয়ার্ডিংয়ে ১৩/৫৪-৫৫ এ নম্বর এলএ কেসের আওতায় অধিগৃহীত ভূমি সংযুক্ত এলাইনমেন্ট নকশা ও প্রাপ্ত দাগসূচিতে দেখা যায়, তফসিল বর্ণিত সম্পত্তির প্রশাসনিক অনুমতির সম্পত্তির অর্ন্তভুক্ত নয়।

এ ছাড়া নাটোর রোড (রুয়েট) হতে রাজশাহী বাইপাস পর্যন্ত রাস্তার এলাইনমেন্ট নকশা ট্রেসিং ক্লথে চাওয়া হয়। কিন্তু এই কাগজপত্রও দেওয়া হয় নি। শুধু দুর্নীতি ও অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এসব কাগজপত্র দেয় নি আরডিএ কর্তৃপক্ষ।

এদিকে রুয়েট থেকে বাইপাস পর্যন্ত চারলেন রাস্তা, ওভারপাস, ড্রেন, কালভার্ট, রাস্তা ও ফ্লাইওভারের লাইটিং এবং টিঅ্যান্ডটি লাইন, গ্যাস সংযোগ লাইন স্থাপনের কাজ গত জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। অথচ কাজ শেষ না হলেও জুলাই মাসে পুরো কাজ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে দুটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

বাস্তবে এ রাস্তার কাজ এখনো ৫০ ভাগ অসমাপ্ত।

এরপরও আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল তারিক কাজ সম্পন্নের প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। একইসঙ্গে ৫ বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন দেখানো হলেও এখনো অধিগ্রহণকৃত জমির বাড়িঘর ভাঙা শেষ হয় নি। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্যে চলছে রাজশাহীর আরডিএ’র উন্নয়নমূলক কাজ।

এ ব্যাপারে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক স্পষ্টত জেলা প্রশাসকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, জেলা প্রশাসক জমি অধিগ্রহণের টাকা দেয় নি বলে রাস্তা নির্মাণে এমন হয়েছে। তিনি জেলা প্রশাসকের চিঠির বিষয়ে দাবি করেন, ‘এ ধরনের কোনও চিঠি আমি দেখি নি বা পাই নি।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, আরডিএ কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণে পুরোটাই নয়ছয় করেছে। যার প্রতিবেদন আমরা দাখিল করেছি। আরডিএ কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সব কাজেই সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

এ ব্যাপারে আরডিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত রহমাতল্লাহ জেলা প্রশাসকের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ওই চিঠি নিয়ে কাজ চলছে, দ্রুতই জবাব দেওয়া হবে।

জমি অধিগ্রহণে নয়ছয় হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চান নি।

এ ব্যাপারে আরডিএ’র চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন বাঙলার কাগজ ও ডনকে জানান, আমি জেলা প্রশাসকের প্রেরিত চিঠির বিষয়ে কিছু জানি না।

‘চেয়ারম্যানের নামে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে, তাহলে কেনো জানেন না’ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘সব চিঠি দেখার সময় আমার থাকে না।’

জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।’