গভর্নরের সঙ্গে আইএমএফের ডিএমডির বৈঠক
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : চার দিনের সফরে বাংলাদেশে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
রোববার (১৫ জানুয়ারি) বেলা ১০টায় ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে তাঁদের এই বৈঠক শুরু হয়। ১৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠকের সূচি রয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের।
এমন এক সময়ে আইএমএফ এর উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা সফর করছেন, যখন এ সংস্থা থেকে বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে শর্তসহ খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে শনিবার (১৪ জানুয়ারি) ঢাকা পৌঁছান অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ।
এইএমএফ বলছে, এই সফর বংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সহায়ক হবে বলে তাঁরা আশা করছে।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করবেন অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ।
বাংলাদেশ যেসব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আছে, সেসব বিষয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি আইএমএফ কীভাবে সেসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে সহযোগিতা করতে পারে, সেসব বিষয় আসবে এসব বৈঠকে।
বাংলাদেশে নারী অধিকার কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে আইএমএফ এর উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের।
কোভিড মহামারির ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে বেশ মান হারিয়েছে টাকা, মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে।
রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানায় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে; জ্বালানি সঙ্কটের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাই মাসে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফ এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অক্টোবরের শেষে ঢাকায় আসেন।
দুই সপ্তাহ সরকারে বিভিন্ন দপ্তর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর ঋণের বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতার কথা জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আইএমএফ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি। এই অর্থ বাংলাদেশ পাবে সাত কিস্তিতে। সব ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম কিস্তির ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার তারা ছাড়তে পারে।
ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ কিস্তি বাংলাদেশ হাতে পাবে ২০২৬ সালে। সুদের হার হবে ২.২ শতাংশ।
আইএমএফ কর্মকর্তা রাহুল আনন্দ তখন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমএফের নির্বাহী পরিষদে উপস্থাপন করবেন। সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে আইএমএফ বোর্ড এ ঋণ প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পারে।
সব ঠিক থাকলে ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ( ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার।
এ ঋণের অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার হাতে নেবে, তার উদ্দেশ্য হবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এই ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।
তবে ঋণের শর্ত নিয়ে কোনও পক্ষই তখন স্পষ্ট কিছু জানায় নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নে রাহুল আনন্দ বলেছিলেন, আইএমএফ এর ঋণ পেলে অন্যান্য বৈশ্বিক উৎস থেকে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে।
তাঁর পরামর্শ ছিলো, প্রবৃদ্ধির চাকাকে আরও গতিশীল করার জন্য কাঠামোগত সমস্যাগুলোতে নজর দিতে হবে, সেই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ, উৎপাদন সুসংহত করা এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তুলতে হবে।
বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে রাহুল আনন্দ বলেছিলেন, মহামারীর সময়ে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেল খোলা থাকায় বাংলাদেশে রেমিট্যান্স বেশি এসেছিল। সেই গতি ধরে রাখতে হলে সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে সরকারও ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে হুন্ডি বন্ধের কিছু উদ্যোগও রয়েছে। অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার কয়েকশ এজেন্টের হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
পাশাপাশি মোবাইল হিসাব বিদেশে বসে পরিচালনা ও মোবাইলেই সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নভেম্বরের সফরের সময় দেশে আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়টি বিভিন্ন অঙ্গনে আলোচনায় গুরুত্ব পায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার, আইন বাস্তবায়ন ও ডিজিটালাইজেশন, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ এবং সরকারের বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির বিষয়গুলো সেই আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেভাবে হিসাব করা হয়, সেই পদ্ধতি নিয়েও তখন কথা হয়। প্রথমবারের আলোচনায় যেসব শর্তের কথা এসেছিলো, তার কয়েকটি ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ।