দেশজুড়ে অগ্রণীর শাখার জালিয়াতিতে জড়িত শামস্‌-উল!

দেশজুড়ে অগ্রণীর শাখার জালিয়াতিতে জড়িত শামস্‌-উল!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রাহাতুল রাফি : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের শাখা পর্যায়ের জালিয়াতিগুলোতেও ব্যাংকটির সদ্য সাবেক হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন শাখায় ব্যাংকটির সাবেক এমডির ‘আসকারা’ এবং ‘প্ররোচনায়’ এসব জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণ গ্রহণে মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামকে একটি পার্সেন্টেজ (অন্তত ২ শতাংশ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ বা তারও বেশি) দিতে হতো বলেই অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জানার জন্য মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।   

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাপারে বেশকিছু অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে। আমরা কিছু অভিযোগ ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছি। আর কিছু অভিযোগ আমলে নিয়েছি। এগুলোর ব্যাপারেও তদন্ত করবো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, এ ধরনের অভাবনীয় জালিয়াতি ব্যাংকে হয়ে থাকলে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে বেশকিছু জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। আর এসব জালিয়াতি সংঘটনের সময় ব্যাংকটির এমডি ও সিইও ছিলেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল। জালিয়াতিগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের নিরীক্ষা, পরিদর্শন এবং অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। আর এসব জালিয়াতি শনাক্ত করার পর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে স্বল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জালিয়াতদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হয় নি। আবার এমনও দেখা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগ আনার পর, সেসব কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে দুদকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। 

এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেছেন, যেহেতু শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির জন্য অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে আবেদন করা হয়েছে, সুতরাং এসব জালিয়াতিতে শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে অগ্রণী ব্যাংক নিমগাছী শাখার কর্মী জাকারিয়া হোসেনের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের বাঁকাই গ্রামের সোনা উল্লাহ প্রামাণিকের ছেলে সিরাজুল ইসলাম প্রামাণিক অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড নিমগাছী শাখার অনুকূলে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। সেই হিসাবে তাঁর নামের চেক বই অন্য কেউ নিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, গাজীপুরে অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একইসঙ্গে ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপককে অপসারণ করে ঢাকার একটি শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এক্ষেত্রে শামস্‌-উল শাখা ব্যবস্থাপককে নিজের কাছে নিয়ে যান বলেই জানা গেছে।

সূত্র জানায়, অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখার গ্রাহক বদরুন নাহার ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘আমার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৭৪২৯, সম্প্রতি আমি আমার অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করি। বদরুল হাসান সনি প্রতারণা করে আমার কাছ থেকে চেক বইয়ের একটি পাতা (নং-৩৪৩৮৭৯) আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে ওই চেকের মাধ্যমে তিনি আমার হিসাব থেকে এক লাখ টাকা তুলে নেন। বিষয়টি ধরা পড়লে ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে আমার অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা দেন সনি।’

ওই শাখার গ্রাহক জুয়েনা বেগম একই অভিযোগ তোলেন। অভিযোগে তিনি জানান, তাঁর হিসাব নম্বর ১৭৪৮০। তাঁর স্বামী ও ছেলে সৌদি আরব চাকরি করেন। সেখান থেকে তাঁর অ্যাকাউন্টে তাঁরা টাকা পাঠান। ১৩ জুলাই তিনি ওই অ্যাকাউন্টের তথ্য জানতে গিয়ে দেখেন তাঁর অ্যাকাউন্টে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা কম। পরে বিষয়টি ম্যানেজারকে অভিযোগ করলে ১৪ জুলাই ৫ লাখ এবং ১৫ জুলাই ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। বদরুল হাসান সনির বিরুদ্ধে ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে দুই ধাপে ওই টাকা তাঁর হিসাবে জমা করা হয়।

অপর গ্রাহক আফতাব উদ্দিন অভিযোগে জানান, তাঁর হিসাব নম্বর ১৯৭২৫। ৪ জুন তিন লাখ টাকা তাঁর হিসাবে জমা করেন। ২২ আগস্ট বিকেলে ফোন মারফত ম্যানেজার জমা ও চেক বইসহ কাগজপত্র নিয়ে তাঁকে ব্যাংকে যেতে বলেন। পরদিন ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার তাঁর অ্যাকাউন্টে তিন লাখ টাকা কম আছে বলে জানান। পরে ব্যবস্থাপকের কাছে তিন লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করার পর সনি ২৩ জুলাই ওই টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা করেন।

এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের সাময়িক বরখাস্তকৃত প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ক্যাশ কর্মকর্তা বদরুল ইসলাম সনি নিজেই গ্রাহকের স্বাক্ষর নকল করে চেক বই উত্তোলন করেছে। পরে গ্রাহকের স্বাক্ষর জাল করে চেকে নিজেই সই করে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছে। ওইসব চেক এন্ট্রি করার সময় চেকের নম্বর এন্ট্রি না করেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে সনি। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর ম্যানেজার তাঁকে শাসিয়েছেনও একবার। 

‘অনেক সময় গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে গেলে গ্রাহকের টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা না করেও, তা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। অর্থাৎ সনি গ্রাহকের টাকা ডেবিট করেও আত্মসাৎ করেছেন আবার ক্রেডিট করেও আত্মসাৎ করেছেন।’

সূত্র আরও জানায়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির সাময়িক বরখাস্তকৃত দুই ব্যাংক কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের কৃষক আইনুল ইসলাম, বদর উদ্দীন ও মনোহরপুর গ্রামের ইন্তাজ আলী বাদি হয়ে কালীগঞ্জের বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে ঋণ জালিয়াতির মামলা করেন। 

এরপর তাঁদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়। 

জানা গেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতাদের টাকা আদায় করে ব্যাংকে জমা না দিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমেও টাকা এসেছে মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের পকেটে।

সূত্র বলছে, অগ্রণী ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে যেসব ঋণ জালিয়াতি হয়েছে, সেগুলোর দায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আর সেসব ঋণের অধিকাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। আর এসব জালিয়াতির সময় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।