৫৩ বছর ধরে শরীরে বুলেট রাশিদার : শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা আর ডান চোখে দেখেন না এখন, প্রয়োজন চিকিৎসা
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায় হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন উপজেলার চিথোলিয়া ও গোপালাশ্রম গ্রামে রাজাকারদের সঙ্গে করে ভরদুপুরে তাণ্ডব চালায় তারা। সেদিন অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এ সময় জীবন বাঁচাতে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে অনেকে শহিদ হন; আহত হন আরও অনেকে। গুলিতে আহতদের একজন গোপালাশ্রম গ্রামের রাশিদা আক্তার।
সেদিনের ২০ বছরের গৃহবধূ রাশিদা এখন ৭৩ বছরের। পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলি তাঁর পিঠের ডানপাশে কাঁধের নিচে লাগে। সেই গুলি আর বের করা যায় নি। ৫৩ বছর ধরেই রাশিদা নিজের শরীরে সেই গুলি বহন করে চলেছেন। এর প্রভাবে অসহনীয় ব্যাথার পাশাপাশি ডান চোখেও দেখতে পান না তিনি। আর্থিক অসচ্ছলতায় ন্যূনতম চিকিৎসাও জোটে নি তাঁর।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শরীরের ভেতরে থাকা গুলির ধকল আর সইতে পারছেন না বলে বৃদ্ধা রাশিদা আক্তার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
সেদিনের ঘটনা :
যুদ্ধ সবে শুরু। বাংলার ১৩৭৮ সালের ৭ ভাদ্র, দুপুরবেলা। উপজেলার চিথোলিয়া পাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাশের গোপালাশ্রমে গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা।
সেখানেও নির্বিচারে চালায় গুলি, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ হত্যাযজ্ঞ। গুলিতে চিথোলিয়া গ্রামের আশুতোষ পাল চৌধুরীসহ দুই গ্রামের সাতজন শহিদ হন। আরও ১৫ জনের মতো আহত হন।
গোপালাশ্রম গ্রামের দিনমজুর মৃত মারফত আলীর ২০ বছর বয়সি স্ত্রী রাশিদা আক্তারও গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন আহতদের মধ্যে একমাত্র রাশিদা আক্তারই বেঁচে আছেন।
দুই গ্রামে সাতজনকে হত্যা :
সেদিন হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব চোখের সামনেই দেখেছিলেন গোপালাশ্রম গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম। তিনি বলেন, এক পর্যায়ে মিলিটারি বাড়ির সামনে এগিয়ে আসছিলো। তখন তিনি বাড়ির পিছনের জঙ্গলের ভেতরে আড়ালে চলে যান। সেখান থেকেই লুকিয়ে দেখেন সব।
আবুল হাশেম বলেন, বেলা ১২টা, সাড়ে ১২টা হবে। মিলিটারি চিথোলিয়া গ্রামে ঢুকে পাল বাড়িতে আগুন দেয়। মিলিটারি আইতাছে জাইন্যা যে যেভাবে পারে জীবন বাঁচানির লাইগ্যা দৌড়াদৌড়ি কইর্যা বাড়িঘর ছাইড়া যাইতাছিলো। পাশেই গোপালাশ্রম গ্রাম। এইহানেও মিলিটারি বাড়িঘরে আগুন লাগায়।
তিনি বলেন, এরার সাথে এলাকার কিছু দালাল লোক আছিলো। আগুন লাগাইছে, লুটতরাজ করছে। আর সমানে গুলি চালাইছে। দুই গ্রামের মানুষ গোপালাশ্রম গ্রামের সামনের চরকান্দি পাড়ায় জড়ো হইছে। এইহান থেইক্যা নাও (নৌকা) দিয়া বিভিন্ন দিকে গেছে। এর মধ্যেই গুলিতে সাতজন মারা গেছেন। কমছে-কম ১৫ জন গুলিতে জখম হইছে।
আবুল হাশেম বলেন, এই সময় বাড়ি ছাইড়া যাওনের লাইগ্যা রাশিদা আক্তারও নাওয়ের মধ্যে উঠছে। তহনই একটা গুলিতে নাওয়ের মাঝি মারা যায়। আরেকটা গুলি লাগে রাশিদা আক্তারের ডান হাতের উপর দিকে। এইবায় কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডব চালাইয়া পরে হেরা গ্রাম ছাইড়া গেছে।
‘নৌকায় খালি রক্ত আর রক্ত’ :
ঘটনার দিন রাশিদার স্বামী মারফত আলী শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। সন্তানদের নিয়ে রাশিদা বাড়িতে একাই ছিলেন।
সেদিনের কথা মনে করে রাশিদা বলেন, গুলাগুলি শুরু হইছে। আমার চাচা শ্বশুর বাড়িতে আছিলো। তিনি কইছে, বেহেই যাইতাছেগা, তুমি বাড়ি থাইক্যা কী করবা। হেরার সাথে তুমিও যাওগা। আমি কইলাম, কই যায়াম (যাবো)। তহন কইলো, বাড়ির সামনে দিয়া ক্ষেতের পাশে দিয়া নামো গা। মনাং গ্রামে যাওগা। পরে আমি বাড়ি ছাইড়্যা বাচ্চারে কোলে লইয়া নামছি। যাওনের পথে একটা ক্ষেতের পাশে বড় গর্তে পইড়া গেছিগা। গর্তের মধ্যে পানি আছিলো। এর মধ্যে বাচ্চারে লইয়া পড়ছি। পরে চাচা শ্বশুর দেইখ্যা আমারে টাইন্যা তুলছে। বাচ্চা পানি খাইয়া পেট ফুইল্যা গেছে। এই সময় মনাং থেইক্যা একটা নৌকা হাওর পারি দিয়া গ্রামের সামনে আইছে। এই নৌকার মধ্যে আমার জা, চাচি শাশুড়ি উঠছে। আরও মানুষ উঠছে। আমার চাচা শ্বশুর বাইয়া নিতাছে।
রাশিদা আরও বলেন, কিছুক্ষণ যাইতেই আমরার নৌকায় গুলি করছে। এই সময় আমার চাচা শ্বশুরের শরীরে গুলি লাগলে নৌকা থেইক্যা ছিইটক্যা পানিতে পইর্যা গেছেগা। এই সময় আমার হাতের উপরের দিকটায় গুলি লাগে। পয়লা বুঝতাম পারছি না। পরে কল-কলায়া রক্ত পড়া শুরু হইছে। নৌকাডার ভেতরে খালি রক্ত আর রক্ত। কিছুক্ষণ পরেই আমি বেহুশ (অজ্ঞান) অইয়া পড়ছি। মনাং গ্রামের মানুষ দূর থেইক্যা দেইখ্যা পরে তাঁরা আইয়া আমরারে নিছে। সন্ধ্যার দিকে কেন্দুয়ার আদমপুর হাসপাতালে নিছে। হেইহানে কোনও ডাক্তার নাই। হাসপাতালে তালা দিয়া হেরা গেছেগা। ময়মনসিংহ নিয়া গেছে। হেইখানেও ডাক্তার নাই। হাসপাতালে অন্য দুইজন আছিলো। হেরা একটু-আধটু চিকিৎসা জানে।
তিনি বলেন, হেরা কইতাছে অহন গুলি বাইর করণ যাইতো না। সংগ্রামের পরে বাইর করণ লাগবো। হেরাই সিলাই কইর্যা কিচু ওষুধ দিয়া দিছে। গুলির জাগাটা শুকাইছে। দেড় মাস পড়ে ডাইন চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে। অহন কিচ্ছুই দেখতাম পারি না। এরপরে থেইক্যা তেমন কোনও কাজকাম করতাম পারি না। অহনও সব সময় ব্যাথা থাকে। মাঝে মাঝে বেশি ব্যাথা হয়। তহন সহ্য করতাম পারি না। গরিব মানুষ আমরা। ভালা চিকিৎসা করাইতাম পারছি না। ব্যাথা উঠলে ব্যাথা কমানোর বড়ি খাই। এইবায় চলতাছি।
সরকারি কোনও সাহায্য পেয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিদা বলেন, না, এই নাগাদই কিছু পাইছি না। কোনও ভাতাও পাইছি না। কোনও চিকিৎসাও না। কতো মানুষে চেষ্টা করতাছে। সাংবাদিকরা নিতাছে। কেউই কিছু করতে পারছে না। সরকারে দেখে না। আপনেরা কী আর করবাইন।
এ সময় তিনি অনেকটা অভিমানের সুরে বলেন, আর কয়দিন বাঁচবো। যেইবায় চলতাছি এইবায়েই যেনো মইর্যা মাটির তলে যাইতাম পারিগা। কেউ কোনও সহযোগিতা করছে না। আমার ছেলেই ঋণ করে, আর যা করে যতোটুকু পারে, আমারে দেখতাছে। এই কারণেই বাইচ্যা রইছি। নাইলেতো আরো আগেই গেলামগায় (চলে যেতাম)।
বয়সের ভারে ন্যূজ্ব রাশিদা বেগম আকুতি জানিয়ে বলেন, সরকারের যদি মন চায়, আমারে বুড়া মানুষরে যদি দয়া করে কিছু টাকা-পয়সা দেউক। আমি যতোদিন বাইচ্যা থাকি, ততোদিন একটু ভালামতন চলতাম পারি।
‘পয়সার কারণে চিকিৎসা করতাম পারছি না’ :
টাকার অভাবে চিকিৎসা হয় নি। শরীরের ভেতরে রয়ে যাওয়া গুলিটির কারণে প্রায় সময়ই অসহনীয় ব্যাথায় কাতর হয়ে যান রাশিদা আক্তার। ব্যাথানাশক ওষুধ খাইয়ে কোনও রকমে দিন পার করছেন তিনি।
সুচিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছেন রাশিদার পরিবারের সদস্যরা।
রাশিদার মেয়ে রহিমা আক্তার বলেন, আমার আম্মা বড়ভাইরে কোলে নিয়া বাড়ি থেইক্যা দৌড়াইয়া গিয়া নৌকার মধ্যে উঠছে। তহন আম্মার শরীরে গুলি লাগছে। তহন নাওয়ের মধ্যে ঢইল্যা পইর্যা গেছেগা আম্মা। পরে অন্যরা আরেক গ্রামে নিয়া গেছে। মা তহনও অজ্ঞান। পরে মময়মনসিংহ নিছে চিকিৎসার লাইগ্যা। ট্যাহার লাইগ্যা হেইহানে পুরা চিকিৎসা করতে পরছে না। হালকা একটু চিকিৎসা করাইছে। গুলিতে যে ছিদ্র হইছে, ওই জাগাটা সিলাই কইর্যা লইয়া আইয়া পড়ছে। আমার বাপের ট্যাহা আছিলো না। ট্যাহা থাকলেতো আম্মার চিকিৎসাটা অইতো। এই পর্যন্তই চিকিৎসাটা করতে পারছি না। ব্যাথা আইয়ে। ব্যাথার জ্বালায় ঘরের অন্য মানুষও ঘুমাইতে পারে না। দিন-রাইত ব্যাথা। খুব বেশি ব্যাথা।
তিনি বলেন, আমার ভাইয়ানও গরিব মানুষ। নিজের সন্তানরারেই খাওয়ায়া পারে না। চিকিৎসা কী করাইবো। ১০ ট্যাহা, ৫ ট্যাহার বড়ি আইন্যা খাওয়ায়, এইভাবেই চলতাছে। খালি ব্যথাটা থামায়া রাহে। অহন সরকারে যদি একটু চিকিৎসাডা করায়া দিতো, তাইলে মরণের আগে দুনিয়াতে একটু শান্তি পাইয়া যাইতো। সংগ্রামের পর থেইক্যা মার খালি অশান্তি। ঠিকমতো খাইতে পারে না। তাঁর সব সময় ভিতরে একটা যন্ত্রণা। সব সময় একটা জ্বর থাহে। একবার খাইলে আরেকবার খায় না।
রাশিদার ছোট ছেলে ইছহাক মিয়া বলেন, চেষ্টাতো করছি। চিকিৎসা কিবায় করায়াম। আমরা গরিব মানুষ। পয়সার কারণে চিকিৎসা করতাম পারছি না। আম্মা আর কয়ডাদিন বাঁচবো। যে কয়ডা দিন বাঁচবো, তাও যদি একটু আরাম কইর্যা যাইতে পারতো। সরকার যদি একটু দেখতো।
রাশিদার বড় ছেলে কাঞ্চন মিয়া বলেন, আমরার সাধ্যমতন চেষ্টা কইর্যা যাইতাছি। আমরারতো আর ক্ষমতা নাই। কোনোমতে সংসারটা টাইন্যা যাইতাছি। আম্মার চিকিৎসাই কইন আর একটু ভালো মতোন রাহন, একটু ভালা খাবার-দাবার কোনোডাই যোগানির ক্ষমতা নাই আমরার। এইবায়েই চলতাছে। কেউ যদি আগায়া আইতো, তাইলে আম্মা যে কয়ডা দিন বাঁচে একটু ভালামতন চইর্যাফিইর্যা যাইতে পারতো।
‘ছররা গুলি ভেতরে থাকতে পারে’ :
এলাকাবাসীও চান একাত্তরে আহত এই বৃদ্ধার সুচিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার।
গোপালাশ্রম গ্রামের বাসিন্দা শহীদ মিয়া বলেন, জীবন সায়াহ্নে এসেও সেদিনের বিভীষিকাময় ঘটনা রশিদাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। বর্তমানে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে উন্নত চিকিৎসা দরকার তাঁর।
‘মুক্তিযুদ্ধে আহত রশিদা আক্তারের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করুক, সরকার তাঁর দায়িত্ব নিক এটা চাওয়া,’ বলে জানান তিনি।