সার্বজনীন পেনশন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী : আজকের দিনটি ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে

সার্বজনীন পেনশন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী : আজকের দিনটি ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : সার্বজনীন পেনশন চালুর আজকের দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলেই জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সম্মানের সঙ্গে (সকলকে) বাঁচার সুযোগ করে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) সকালে গণভবনে সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক জনগণকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে তিনি সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

সার্বজনীন পেনশনের ফলে বৈষম্য দূর হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৃদ্ধ বয়সে অনেকে পরিবারের কাছেই বোঝা হয়ে যান। পরিবারের কাছে যেন মূল্য থাকে, কেউ যেন বোঝা হয়ে না যান, এই কর্মসূচি তাতে ভূমিকা রাখবে। বৃদ্ধ বয়সে হাত পাততে হবে না। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল মানুষের কাছে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছিলেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য কাজ করছি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করছি।

বয়স্ক নাগরিকদের একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সার্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করলো সরকার। 

প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা আর সমতা- সার্বজনীন পেনশনের চার কর্মসূচি আজ চালু হলো। আরও দুটি স্কিম পরে সুবিধাজনক সময়ে চালু করা হবে।

সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ এই কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারবেন। সরকারের সার্বজনীন কর্মসূচিতে ১৮ বছর বয়সে যুক্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা মিলবে। যুক্ত হতে বয়স যত বাড়বে, আনুপাতিক হারে কমতে থাকবে সুবিধাও। এভাবে যে কেউ তাঁর মোট চাঁদার (কিস্তি) চেয়ে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩০ গুণ থেকে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৩১ গুণ টাকা পেনশন পাবেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের গত রোববার (১৩ আগস্ট) জারি করা সার্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন গ্রাহক। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তাঁর নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন ১৫ বছর। 

বেসরকারি কর্মীদের জন্য ‘প্রগতি’ স্কিম :
বেসরকারি কর্মচারীরা মাসিক ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে প্রগতি স্কিমে যুক্ত হতে পারবেন। চাঁদার ৫০ শতাংশ কর্মীরা এবং বাকি ৫০ শতাংশ কোম্পানি পরিশোধ করতে পারবে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সার্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ না নিলে এর কর্মীরা স্বউদ্যোগে এতে অংশ নিতে পারবেন। বেসরকারি কর্মীরা ১৮ বছর বয়সে এ স্কিমে যোগ দিয়ে কোনো ব্যক্তি ৪২ বছরে মাসিক ২ হাজার টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে তিনি মাসে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা পেনশন পাবেন। একই মেয়াদে ৩ হাজার টাকা মাসিক চাঁদায় ১ লাখ ৩ হাজার ৩৯৬ টাকা মাসিক পেনশন পাবেন। ৫ হাজার টাকা মাসিক চাঁদায় ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা মাসিক পেনশন আজীবনের জন্য পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এ স্কিমে ৪২ বছর ধরে ৫ হাজার টাকা করে মাসিক চাঁদা দেওয়া হলে ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত সময়ে পেনশন হিসাবে মোট পাওয়া যাবে ৩ কোটি ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা, যা মোট চাঁদার প্রায় ১২ দশমিক ৩১ গুণ। তবে এ স্কিমে ১০ বছরে ধরে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা করে দিলে ৬০ বছর বয়সের পর প্রতি মাসে পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৬০ টাকা। এ ক্ষেত্রেও মোট চাঁদার তুলনায় ২ দশমিক ৩০ গুণ বেশি পেনশন পাওয়া যাবে।

প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ :
প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিমে মাসিক চাঁদা ধরা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা। বিদেশ থেকে এ স্কিমে যোগদানের পর ৬০ বছর বয়সের আগেই কেউ দেশে ফিরলে তারা দেশীয় মুদ্রায় চাঁদা পরিশোধ করতে পারবেন অথবা স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন। পেনশন স্কিমের মেয়াদ শেষে স্থানীয় মুদ্রায় পেনশন দেওয়া হবে। একজন প্রবাসী ১৮ বছর বয়সে এ স্কিমে যুক্ত হয়ে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স পর তিনি সরকারি তহবিলে মোট ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকার চাঁদা দেবেন। এর পর ৬০ বছর থেকে ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত মাসিক ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে পাবেন। ফলে তাঁর মোট পাওয়া পেনশনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটি ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৯০০ টাকা, যা মোট চাঁদার প্রায় ১২ দশমিক ৩১ গুণ। একই স্কিমে যোগ দিয়ে কেউ ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিলে তিনি ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা পেনশন পাবেন। আবার একই মেয়াদে প্রতি মাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা চাঁদা দিলে প্রবাসীরা মাসিক ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯১ টাকা করে আজীবন পেনশন পাবেন। তবে যদি কেউ এই স্কিমের আওতায় সর্বনিম্ন ১০ বছর ধরে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দেন, তাহলে তিনি মোট জমা দেবেন ৬ লাখ টাকা। বিনিময়ে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে তিনি প্রতি মাসে ৭ হাজার ৬৫১ টাকা করে মোট ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৮০ কোটি টাকার পেনশন পাবেন। এ ক্ষেত্রে মোট চাঁদার তুলনায় ২ দশমিক ৩০ গুণ বেশি পেনশন পাওয়া যাবে।

অতিদরিদ্রদের জন্য ‘সমতা’ :
সমতা স্কিমে চাঁদার পরিমাণ মাসে ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে গ্রাহক প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেবেন। বাকি ৫০০ টাকা সরকার পরিশোধ করবে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী অতিদরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে। এ স্কিমের আওতায় ১৮ বছর বয়সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। আর ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সীরা অন্তত ১০ বছর ধরে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ১ হাজার ৫৩০ টাকা করে পেনশন পাবেন।

অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য ‘সুরক্ষা’ :
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’ নামে স্কিম থাকছে। কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এ স্কিমে মাসিক চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার, ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। সুরক্ষা স্কিমে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা দিয়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে পেনশন পাওয়া যাবে। একই মেয়াদে ২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকার পেনশন পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিলে আজীবন মাসিক ১ লাখ ৩ হাজার ৩৯৬ টাকা এবং প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিলে আজীবন মাসিক ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন।