সুদহারে ২ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক স্প্রেডে চলছে চার ব্যাংক!

সুদহারে ২ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক স্প্রেডে চলছে চার ব্যাংক!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : সুদ খাত যে কোনও ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। বিতরণকৃত ঋণ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করে ব্যাংক। এ ‘ব্যাকরণ’ মেনেই পরিচালিত হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। যদিও দেশের সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ছয় ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার এখন ঋণের গড় সুদহারের চেয়ে বেশি। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের গড় সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) এখন নেমে এসেছে ঋণাত্মক ধারায়। এর মধ্যে চারটিরই স্প্রেড এখন ঋণাত্মক ২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ চার ব্যাংক হলো পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, বেসিক ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের স্প্রেডও ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে বিডিবিএলের স্প্রেড এখনো ঋণাত্মক দেড় শতাংশে ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক ১ শতাংশে নামে নি।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপির খাতায়। ফলে ঋণ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। মূলধন খুইয়ে কিংবা অন্য খাতের আয় দিয়ে কোনও রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। বিতরণকৃত ঋণ থেকে মুনাফার পথই যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কোনও ব্যাংকের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ স্প্রেডে ঋণ বিতরণ করতে পারে। দেশের ভালো ব্যাংকগুলো ৪ শতাংশের চেয়েও বেশি স্প্রেড নিয়ে উচ্চ মুনাফা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে দেশের ব্যাংক খাতের গড় স্প্রেড ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। যদিও এ সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছয়টি ব্যাংকের স্প্রেড ছিল ঋণাত্মক ধারায়। নেতিবাচক ধারায় থাকা পদ্মা ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ফারমার্স থেকে পদ্মা হওয়া এ বেসরকারি ব্যাংকটির স্প্রেড সর্বনিম্ন। 

ঋণাত্মক স্প্রেডের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্যাংকটি হলো ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। বাংলাদেশে পাকিস্তানি এ ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৮ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। স্প্রেডের দিক থেকে তলানিতে থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩০ শতাংশ, বিডিবিএলের ঋণাত্মক ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাকরণ মেনে চলতে ব্যর্থ এ ছয় ব্যাংকের সুদ খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। ঋণ বিতরণে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের শিকার হয়ে ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তায় কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব।

ঋণাত্মক স্প্রেড নিয়ে কোনও ব্যাংকের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা সম্ভব নয় বলে মনে করেন ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ ব্যাংকার বলেন, ‘স্প্রেড ঋণাত্মক হওয়া মানে ব্যাংকের কোনও না কোনও খাতে ক্ষয় হচ্ছে। সুদ খাত হলো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। সেখান থেকে আয় না হলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। আর অন্য উৎস থেকে পর্যাপ্ত আয় না থাকলে ব্যাংক লোকসানে পড়ে। কোনও ব্যাংক লোকসানে পড়লে সেটির মূলধন ক্ষয় হয়। আর দীর্ঘমেয়াদে লোকসান মানেই দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া। এ ধরনের ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।’

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল-পরবর্তী পাঁচ বছরে লুণ্ঠনের শিকার হওয়ার পর গত ১০ বছরে ৪ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর কথা বলে বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয় সরকার। বিপুল অংকের এ অর্থ পেয়েও বেসিক ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উল্টো ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। বেসিকের বিতরণকৃত ঋণের ৫৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ এখনো খেলাপি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকাই ছিল খেলাপির খাতায়। আদায় অযোগ্য হওয়ায় আরো ২ হাজার ৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকটি। খেলাপি হওয়া ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না। বেসিক ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণও ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার বেশি। অথচ বিপর্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে সফল ব্যাংক ছিল এটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে শেষে বেসিক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। স্প্রেডের হার ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০২২ সালে সুদ খাতে ব্যাংকটি ২৪৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। আর ২০২১ সালে এ খাতে লোকসান ছিল ৪৪২ কোটি টাকা। গত ১০ বছর ধরেই এভাবে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে বেসিক ব্যাংক।

বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ খেলাপি হওয়ায় সুদ খাত থেকে আয় করা যাচ্ছে না বলে জানান বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে বেশি সুদে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিন্তু খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ থেকে আয় হচ্ছে না। এ কারণে সুদ খাতে বেসিক ব্যাংকের লোকসান হচ্ছে। সরকারের কাছে আমরা স্বল্প সুদের আমানত চেয়েছিলাম। সেটি না পাওয়ায় ব্যাংকটিকে টেনে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরুর পর পরই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। এক পর্যায়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে। বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে এগিয়ে আসে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। চার বছর আগে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক করার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও সহায়তা পেলেও ব্যাংকটির দৃশ্যমান কোনও উন্নতি হয় নি। বরং ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ পদ্মা ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আবার বিদেশী বিনিয়োগ আনার কথা বলা হলেও তা আর আসে নি। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মূলধন হিসেবে জোগান দেয়া অর্থও শেষ করে ফেলেছে পদ্মা ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষেই প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে ছিল ব্যাংকটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে পদ্মা ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ ছিল ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। সে হিসাবে পদ্মা ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বর্তমানে খেলাপি ঋণের হার ৫৯ শতাংশেরও বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক হিসাবে কার্যক্রম শুরুর পর বিতরণ করা কোনও ঋণ খেলাপি হয় নি। এখন যে খেলাপি ঋণ আছে, সেগুলো ফারমার্স ব্যাংকের। তবে আমরা সে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আদায় পরিস্থিতিও ভালো। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করছি, পদ্মা ব্যাংক দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে।’

বাংলাদেশে বিতরণকৃত ঋণের কোনও হদিস নেই ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে পাকিস্তানি এ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিলো ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকাই খেলাপির খাতায়। সে হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার ৯৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিতরণকৃত ঋণ থেকে কোনও আয় না থাকায় ব্যাংকটির স্প্রেড ঋণাত্মক ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

স্প্রেড ঋণাত্মক হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির স্প্রেড হার ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হারও ৮৬ শতাংশের বেশি। আর সরকারি খাতের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণের হার ৪৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ব্যাংকটির স্প্রেড ঋণাত্মক ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। 

সরকারি-বেসরকারি মালিকানার বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশে। সে হিসাবে এ ব্যাংকটিরও স্প্রেড ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। প্রায় ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে বিপদে আছে ব্যাংকটি। তবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তাজুল ইসলামের দাবি ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা ২৩৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নগদে আদায় করেছি। এটি কমার্স ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের জুনের মধ্যেই ব্যাংকের আমানত ৫০০ কোটি টাকা বেড়েছে। স্বল্প সুদের আমানত বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা স্প্রেড ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি।’