রংপুরে নৃশংসতা : এমন ভয়ংকর রাত যেনো আর কারও জীবনে না আসে

রংপুরে নৃশংসতা : এমন ভয়ংকর রাত যেনো আর কারও জীবনে না আসে
ডন প্রতিবেদক, রংপুর : ‘আমার জীবনের ভয়ংকর রাত কেটেছে গতকাল রবিবার (১৭ অক্টোবর)। ভাবলে এখনো গা শিউরে উঠছে। এমন ভয়ংকর রাত যেন কারও জীবনে না আসে।’ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়করিমপুর গ্রামের হরিদাস রায় (৫০) এভাবেই গতকাল রাতে তাঁদের গ্রামে দুর্বৃত্তদের হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সময়ের কথা বলছিলেন। হরিদাস রায় বলেন, ‘রাতে যখন পাশের বাড়িতে হামলা হয়, তখন তিন বছরের নাতি সার্থক রায় ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পাশের ধানখেতে ঢুকে পড়ি। স্ত্রীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে নাতিকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। শুধু শোরগোল কানে বাজছিলো। একসময় কে যেনো টর্চ জ্বালায় ধানখেতের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে অবুঝ নাতির কাশি শুরু হলে তাঁর মুখ চেপে ভগবানের নাম জপতে থাকি। এভাবে অন্ধকারে কেটে যায় অনেকটা সময়। এরপর মাইকে শুনতে পাই, কে যেন বলছেন- আমরা প্রশাসনের লোক, আপনারা কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকলে বাইরে আসেন। আর কোনও সমস্যা নেই। পরে একটু মাথা উঁচু করে দেখি পুলিশ মাইকিং করছে। তখন বাসায় ফিরেছি।’ গতকাল রবিবার (১৭ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে ওই গ্রামের হরিদাসের মতো অনেকের রাতের বেশির ভাগ সময় কেটেছে জঙ্গলে কিংবা ধানখেতে। ওই গ্রামের রানীবালা (৩৫) বলেন, ‘যখন বুঝলাম গ্রামে হামলা হয়েছে, তখন আমার ক্লাস এইটের ছেলে গৌতম রায়কে নিয়ে পাশের ধানখেতের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। শরীর চুলকাতে থাকে। তারপরও কষ্ট করে শুয়ে থাকি। স্যাররা (পুলিশ) মাইকে ডাকলে ভোরে বের হয়ে বাড়িতে এসে দেখি, ঘরে আগুন জ্বলছে। জীবনে এমন কষ্টের দিন আসবে, কোনোদিন ভাবি নি।’ কণিকা রানী বলেন, ‘মোর ছইলটা হাইস্কুলে পড়ে। হঠাৎ করি রাইতোত ২০-২৫ জন লোক বাড়িত ঢুকিয়া মোক ধাক্কা মারে। ছইল আন্দারোত (অন্ধকারে) কোনটে পালেয়া যায় জানো না। মুই যায়া ঝাড়ের ভেতর ঢুকি দ্যাখো আরও চারজন নুকিয়া আছে। পরে পুলিশ আসলে হামরা ঝাড় থাকি বেরাই। সকালে ছইলটা বেরাইচে। ধানবাড়িত নুকিয়া আছিলো।’ হামলাকারীদের ভয়ে ধানখেতে কিংবা জঙ্গলে রাত কাটানোর এমন বর্ণনা দিয়েছেন ওই গ্রামের মিনতি রানী, দেবদাস রায় এবং নিরঞ্জন রায়সহ অন্তত ১৫ জন। রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আদলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ওই গ্রামে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সবকিছু পুড়ে যায়। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই গ্রামে দুর্বৃত্তরা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মন্দিরে ও বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে পুড়ে যায় ২১টি ঘরসহ ধান, চাল, আসবাব এবং ঘরে থাকা জামাকাপড়সহ প্রয়োজনীয় সবকিছু।