রিকশাচিত্র : বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি
সিদরাতুল সাফায়াত ড্যানিয়েল : আমরা যাঁরা ঢাকায় বসবাস করি, তাঁদের মধ্যে একটা কথা মোটামুটিভাবে প্রচলিত-‘রিকশা হচ্ছে জমিদারি বাহন’। যুক্তি হিসেবে অনেকে বলেন, সড়কপথে অন্য যে কোনও বাহনের তুলনায় রিকশায় চড়ার খরচটা একটু বেশি। ছোট দূরত্বে রিকশা বেশ কাজের হলেও, আরামদায়ক ভূমিকার জন্যও এই ত্রিচক্রযান বেশ জনপ্রিয়। তবে এই ‘জমিদারি বাহনের’ নেপথ্যে আরেকটি যুক্তি রয়েছে-‘রিকশাচিত্র’।
ঢাকাকে রিকশার শহর বলা হলেও, মানব চালিত এই বাহনটির উদ্ভব এদেশে হয়নি। তবুও দীর্ঘ সময় ধরে জীবিকার হিসেব-নিকেষ থেকে শুরু করে সুখ, বেদনা অথবা আকাশছোঁয়া স্বপ্নের মতো জীবনের প্রায় প্রতিটি ধারাই গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে তিন চাকার এই বাহনে বসে। প্রায় প্রতিটি রিকশার পিছনে, হুডে এবং ছোট ছোট অনুষঙ্গে একধরনের বিশেষ চিত্রকলা লক্ষ করা যায়—যা রিকশাচিত্র নামে পরিচিত। রিকশাচিত্র বাংলাদেশের নব্য রোমান্টিকতার মধ্যে আবির্ভূত একটি শিল্পধারা, যাকে বহমান ঐতিহ্য বা লিভিং ট্র্যাডিশন বলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে রিকশাচিত্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
প্রথম রিকশা ও আমাদের স্বীকৃতি :
রিকশার আবিষ্কার সর্বপ্রথম কোথায় হয়েছিল, তা নিয়ে নানান মতভেদ রয়েছে। তবে ধারণা করা হয় জাপানেই সর্বপ্রথম রিকশার প্রচলন ঘটে। উপমহাদেশে সর্বপ্রথম রিকশা এসেছিল ভারতের সিমলায়, ১৮৮০ সালে। কথিত আছে ১৯১৯ সালের দিকে মিয়ানমারের রেঙ্গুন থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম রিকশা আসে। তবে ঢাকায় প্রথম রিকশা নিয়ে আসা হয় ১৯৩০ সালে এবং সেটি আসে কলকাতা থেকে।
বাংলাপিডিয়ার মতে, ১৯৩৮ সালের দিকে মাল আনা-নেওয়ার কাজে পাট ব্যবসায়ীরা নেত্রকোনা শহর এবং নারায়ণগঞ্জে চেইন লাগানো রিকশার প্রচলন করেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ঢাকায় রিকশা প্রচলিত হয়েছে ১৯৪০ সালের দিকে। পৌরসভার রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরে রিকশা ছিল মোট ৩৭টি। কালের ব্যবধানে ১৯৯৮ সালের দিকে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজারে। বাংলাদেশে রিকশার ব্যবহার উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০১৪ সালের ২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাকে রিকশার নগরী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়াও চলতি বছরের ০৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকার কমিটির ১৮তম অধিবেশনে ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র বৈশ্বিক বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
রিকশাচিত্রে সেকাল-একাল :
রিকশাকেন্দ্রিক যে ঐতিহ্য ও শিল্প গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, তন্মধ্যে রিকশার পেছনে যেসব চিত্রকর্ম দেখা যায়, তা বাংলাদেশের একান্তই নিজস্ব শিল্প। মোটামুটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছু আগে ঢাকায় রিকশা ও রিকশাচিত্রের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয়। রিকশাচিত্র নামে পরিচিত এই শিল্পকর্ম হচ্ছে পাতলা টিনের পাতের ওপর আঁকা চিত্র, যা পরে রিকশার কাঠামোর পেছন দিকে বিশেষভাবে জুড়ে দেওয়া হয়। রিকশাচিত্রের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তার কারণে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পধারা গত ৭৫ বছরে বিশ্ব সংস্কৃতির একটা অংশ হয়েছে উঠেছে, যা সত্যি গৌরবের ও বিস্ময়কর।
বাংলাদেশে রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তু ও রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের বেশ গভীর প্রভাব রয়েছে। অনন্য অঙ্কনশৈলী এবং উজ্জ্বল এনামেল রঙে সিনেমার ব্যানারের আদলে আঁকা রিকশাচিত্র খুব সহজেই আকৃষ্ট করত মানুষকে। ষাটের দশকের দিকে বিভিন্ন সময়ের ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বা সিনেমার কোনো দৃশ্য স্থান পেয়েছে রিকশাচিত্রের বিষয় হিসেবে। নিশান, চোর, ডাকু সুলতান, বেদের মেয়ে জোছনা, লাইলি-মজনু প্রভৃতির মতো অসংখ্য চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের আঁকা হয়েছে রিকশাচিত্রে।
সত্তরের দশকের দিকে রিকশায় মানুষের ছবি আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ায় গ্রামীণ দৃশ্যকল্প, ফুল, লতাপাতা, পাখি ইত্যাদি চিত্র স্থান পেয়েছে এই শিল্পকর্মে। তাই বিভিন্ন সময় নানান কারণে রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়েছে। রাজধানীর বকশীবাজার, বেড়িবাঁধ, মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ বেশ কয়েক জায়গায় রয়েছেন রিকশা চিত্রশিল্পী।
রিকশাচালকরা কী ভাবছেন :
রিকশাচালক শহীদ উল্লাহ, যিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে জনবহুল ঢাকা শহরের যানজটপূর্ণ এবং সরু রাস্তায় রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই শিল্পের স্বীকৃতির খবর শুনে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত। এটিকে তিনি ‘ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল অংশ এবং নগর লোকশিল্পের একটি গতিশীল রূপ’ বলে অভিহিত করেছেন। ৪০ বছর বয়সী রিকশাচালক মোহাম্মদ সবুজের মতে এই শিল্প আজকাল বিরল হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘যখন আমি ছোট ছিলাম, রিকশাগুলো ছিল রঙিন কারুকার্য এবং ডিজাইনে ভরপুর কিন্তু আজকাল সেই প্রবণতা কমে গেছে।’
রিকশাচিত্রীদের প্রত্যাশা :
ইউনেস্কোর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান টিম কার্টিস বলেছেন যে রিকশা পেইন্টিং ‘হুমকির মধ্যে’ ছিল, এবং এই স্বীকৃতিটি মূলত এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্ভাবনী এবং টেকসই উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা; যা রিকশা চিত্রশিল্পীদের নৈপুণ্যকে উত্সাহিত করতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে রিকশা চিত্রশিল্পী হানিফ পাপ্পু (৬২) যিনি প্রায় ৫৫ বছর ধরে এই পেশার সাথে জড়িত, তিনি বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, এটি আমাদের একান্তই নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু তরুণরা এই শিল্পকর্মকে পেশা হিসেবে নিতে খুবই কম আগ্রহী, কেননা তারা দেখে যে প্রশিক্ষকরাই তাদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন পাচ্ছে না। তাই এখন কেউ তাদের সন্তানদের এই শিল্প শিখতে পাঠায় না।
পাপ্পুর মতে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি রিকশাচিত্রের পতন ঠেকাতে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তার মতে, এর ফলে রিকশাচিত্র নিয়ে আরো বেশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাবে। এরই মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদ জানান, ১৮ জানুয়ারি কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন সাজানো হবে রিকশা চিত্রশিল্পীদের দিয়ে। অতিসত্বর কর্মশালার মাধ্যমে এ শিল্পকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন সচিব।
বিপিএলের থিমে ‘রিকশাচিত্র’ :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হবে দশম বিপিএল। তবে এখন থেকেই বিপিএলের আমেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনার চেষ্টা করছে বিসিবি। বিপিএলের লোগোর দুই পাশে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের নকশা ফুটে উঠেছে। এমন নকশায় বিসিবি বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকেই ফুটিয়ে তুলেছে। বিশেষ লোগো প্রকাশ করে সংস্থাটি লিখেছে, ‘ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত হন দর্শকেরা। চূড়ান্তভাবে রোমাঞ্চকর ক্রিকেট উপভোগ করার সময় এখন।’ ধারণা করা হচ্ছে, এবারের আসরে মূল থিম হিসেবে ‘রিকশাচিত্রকে’ ব্যবহার করা হবে।
ফ্লাইওভারে ‘রিকশাচিত্র’ :
রাজধানীর মগবাজার ও মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের পিলার ক্যানভাসে ফুটে উঠছে ‘রিকশাচিত্র’। পথচারীদের মুগ্ধ করছে এসব আঁকিবুঁকি। ফ্লাইওভারে আঁকা এসব চিত্রকর্মের মাধ্যমে কিছু ‘শিক্ষণীয়’ বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আছে ‘হর্ন বাজানো নিষেধ’, ‘শহরটাকে ভালোবাসি’, ‘দেশটাকে ভালোবাসি’, ‘গাছ লাগাই পরিবেশ বাঁচাই’ এমন নানা স্লোগান। এছাড়া ফুল, পাখি, সূর্য এবং আরেকটিতে ফুলের নকশার সঙ্গে নৌকা দিয়ে অবহমান বাংলার সংষ্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রিকশাচিত্রে রঙিন টি-স্টল :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসএসি অগুনতি মানুষের আড্ডা ও স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনেকে ডুবে যেতে থাকেন ব্যক্তিগত সোনালি অতীতে। চলতি বছরে টিএসসির টি-স্টলগুলো সেজেছে বর্ণিল রিকশাচিত্রে। টি-স্টলগুলোকে এভাবে রঙিন করে তোলার নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন ‘মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ ২০১৯’ মুকুটধারী মডেল শিরিন আক্তার শিলা। তিনি বলেন, ‘মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তো রিকশাচিত্রকে নিয়ে আসতে পারছি। সেই ভাবনা থেকেই আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস।’