ডন প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : বাজারের এক পাশের অস্থায়ী একটি দোকান। সামনের রাখা আটটি ঝুড়ি। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন একে একে আসছেন আর ঝুড়ি থেকে তুলে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় সবজি। তবে এর জন্য কোনও দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর ইউনিয়নের নজুমিয়াহাট চৌমুনহীতে আজ সোমবার সকাল দেখা গেল এই চিত্র। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আরও দেখা গেল, এক নারী বিভিন্ন পদের এক টুকরি সবজি নিয়ে এসেছেন। সব কটি তিনি ওই দোকানের ঝুড়িতে রেখে চলে গেলেন।
দোকানে টানানো ফেস্টুনে লেখা, ‘যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা ডোনেট (দান) বাক্সে সবজি রাখতে পারেন। আর যাঁদের সবজি কেনার টাকা নেই, তাঁরা ডোনেট বাক্স থেকে বিনামূল্যে সবজি নিয়ে যেতে পারবেন।’
বাজারে সম্প্রতি বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় একদল তরুণ-যুবক মিলে চালু করেছেন ‘মানবিক বাজার’ নামের এই বিনামূল্যে সবজির হাট। উদ্যোক্তাদের পকেটের টাকায় চার দিন আগে এই বাজার চালু করা হয়। তাঁদের এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে এখানে লোকজন এসে ঝুড়িভর্তি সবজি দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেনার সামর্থ্য নেই, এমন লোকজন এসে এখান থেকে বিনামূল্যে সবজি নিয়ে যাচ্ছেন।
আজ সোমবার (২১ মার্চ) বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত সরেজমিন দেখা গেছে, এই সবজির দোকান থেকে অন্তত ১৫ জন নারী পুরুষ এসে সবজি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। দিয়ে গেছেনও কয়েকজন। এখানে ৭ থেকে ৮টি ঝুড়িতে ভরা ছিল বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, আলু, শসা, লালশাকসহ নানান সবজি।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, শুধু এই বাজারে নয়, এ রকম সাত স্থানে নিজেদের অনুদানে এ মানবিক বাজারের শাখা খুলেছেন তাঁরা। ৮ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী গরিব উল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় প্রথম এ বাজার চালু করা হয়। এরপর গত এক সপ্তাহে হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট, বুড়িশ্চর ইউনিয়নের নজুমিয়াহাট, নগরীর চান্দঁগাও কালামিয়া বাজার, কাজিরহাট, চকবাজার, পূর্ব বাকলিয়া, পাহাড়তলী থানার অলংকার এলাকার ৭ স্থানে এ মানবিক বাজার চালু করেছেন তাঁরা। তাঁদের ইচ্ছা, এ বাজার তাঁরা চালিয়ে নেবেন। আরও একাধিক স্থানে এ রকম বাজার চালু করার কাজ করছেন বলেও জানালেন উদ্যোক্তারা।
মানবিক বাজারের উদ্যোক্তা সবাই রাউজান ও হাটহাজারীর বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন স্বেচ্ছাসেবী আবু হাসান, মুহাম্মদ রাশেদ উদ্দিন, কায়সার আলী চৌধুরী, আরশাদ সিদ্দিকী, সানা উল্লাহ চৌধুরী, মুহাম্মদ আলম ও নাসির ফারুকী।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এক টুকরি সবজি নিয়ে এসে ওসব ঝুড়িতে রেখে যাচ্ছিলেন চান্দগাঁও মোহরা এলাকার গৃহবধূ জাহেদা আকতার। তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘জানতে পারার পর উদ্যোগটা আমার অনেক ভালো লাগছে। আমার সামর্থ্য থাকায় বাজার করে এখানে চার থেকে পাঁচ পদের সবজি ডোনেট বাক্সগুলোতে রাখলাম। কারণ, অনেক মানুষ আমাদের আশপাশে আছে যারা সবজিও কিনতে পারছে না।’
সবজি নিয়ে যাওয়ার সময় জরিনা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘এক থলে ভরে সবজি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। খুব খুশি হয়েছি। যাঁরা কোনও টাকা ছাড়া আমাদের থলেভর্তি সবজি দিলেন, তাঁদের জন্য দোয়া করি।’
উদ্যোক্তাদের একজন মুহাম্মদ রাশেদ উদ্দিন বলেন, করোনা সংকটের পর যেভাবে দ্রব্যমূল্য ও সবজির দাম বেড়েছে, তাতে অনেকেই না খেয়ে মরার অবস্থা তৈরি হচ্ছে। তাঁরা কয়েকজন মিলে চিন্তা করে এ রকম একটি উদ্যোগ নেন, যাতে দরিদ্র লোকজন উপকৃত হবেন। এরপর এক সপ্তাহ ধরে হাটহাজারী ও চট্টগ্রাম নগরীর ৭ স্থানে মানবিক বাজার চালু করেছেন তাঁরা। এ কর্মসূচিতে প্রচুর সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা।
ওই সবজি হাটের পাশের কাপড়ের দোকানি নুর মোহাম্মদ বলেন, কয়েক দিন ধরেই এখানে বিভিন্ন মানুষ এসে সবজির টুকরি দিয়ে যাচ্ছে, আবার অনেকে থলে ভরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে আরও মানুষ সবজি কিনে খেতে না পারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহ পাবে।
উদ্যোক্তাদের আরেকজন আরশাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘এই বাজার আমরা সচল রাখার জন্য কাজ করছি। আশা করছি আমরা সফল হয়ে মানবিক এ সবজি বাজার বছরব্যাপী চালু রাখতে পারব।’
হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহেদ হোসাইন বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, গরিব মানুষের জন্য এই মানবিক বাজার সারা দেশে ছড়িয়ে যাক। তাহলে মানুষ ভীষণ উপকৃত হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময় এই উদ্যোগ সারা দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।