মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স কমার কারণ।

মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স কমার কারণ।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমার পেছনে প্রধান কারণ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কম অর্থ পাঠানো।

রেমিট্যান্স মোট কমেছে পৌনে ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কেবল সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে কমেছে সোয়া ২ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশিরা কাজ করলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিট্যান্স আসে মূলত ৩১টি দেশ থেকে। এর মধ্যে ২টি ছাড়া সব দেশ থেকেই আয় কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধস নেমেছে মালয়েশিয়ার রেমিট্যান্সে। এই দেশ থেকে আসা প্রবাসী আয় কমেছে ৫০ শতাংশের মতো।

শতকরা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমেছে সিঙ্গাপুর থেকে। তৃতীয় অবস্থানে তেলসমৃদ্ধ আরবের দেশ ওমান।

শতকরা হিসেবে ২০ শতাংশের মতো পতন হলেও টাকার অঙ্কে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে সৌদি আরব থেকে।

গত অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটির মতো প্রবাসী ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।

২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিলো ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার; যা ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স।

অর্থাৎ এবার কম এসেছে ৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।

মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। মূলত প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে করোনাজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।

ওই বছর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি প্রবাসী আয় আসে। ওই অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই ২ বিলিয়ন (২ শ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে দেশে।

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসী বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সবমিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাঁদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং নভেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে মধ্যপাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। তার ইতিবাচক প্রভাব আমাদের রেমিট্যান্সে পড়বে। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স বাড়লে এবার ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।’

যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কমেছে রেমিট্যান্স : শতকরা হিসেবে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে মালয়েশিয়া থেকে। এই দেশ থেকে রেমিট্যান্স অর্ধেকে নেমে এসেছে।

গত অর্থবছরে দেশটি থেকে ১০২ কোটি ১৮ লাখ ডলার এসেছে; আর আগের বছরে এসেছিলো ২০২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এক্ষেত্রে শতাংশ হিসাবে রেমিট্যান্স কমেছে ৪৯ শতাংশ।

সবমিলিয়ে দেশটি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ কম এসেছে এবার।

ওমান থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ৪১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত বছর এসেছিলো ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স। এবার এসেছে শূন্য দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার।

সিঙ্গাপুর থেকে কমেছে ৩৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ রেমিট্যান্স। গতবার এসেছিলো ৬২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এবার এসেছে ৩৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার।

শতকরা হিসেবে ক্রমিকে ৪ নম্বরে থাকলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে সৌদি আরব থেকে আয় কমায়।

প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে যে দেশ থেকে, সেটি থেকে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২০ দশমিক ৬১ শতাংশ।

২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন দেশটিতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাঠিয়েছেন ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন) ডলার।

অর্থাৎ এবার দেশটি থেকে রেমিট্যান্স কম এসেছে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত অর্থবছরে ২০৭ কোটি ১৮ লাখ (২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। আগের বছরে এসেছিলো ২৪৪ কোটি (২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন) ডলার। কমেছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৩৭ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্সের দিক থেকে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে আরবের অন্য দেশগুলোর মধ্যে কুয়েত থেকে কমেছে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা প্রায় ২০ কোটি ডলার; কাতার থেকে কমেছে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ বা সাড়ে ১০ কোটি ডলার।

মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স এতো বেশি কমার কারণ কী- এ প্রশ্নে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘এই দেশগুলো থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে আসে। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন সব টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। সে কারণে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে।’

তিনি বলেন, ‘যাঁর কাছে যা জমানো টাকা ছিলো, পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সব বৈধ পথে দেশে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। সে কারণেই ওই অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিলো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আবার আগের মতো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।’

পতন ঠেকিয়েছে যেসব দেশ : রেমিট্যান্সের ভাটার মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় পাঠানো দেশ যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রেখেছে। কিছুটা কমলেও সেটি অনুল্লেখযোগ্য।

আগের অর্থবছরে দেশটি থেকে ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পালিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এবার তা কিছুটা কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স বরং কিছুটা বেড়েছে। এবার এসেছে ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর ছিলো ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বিস্ময় দেখিয়েছেন ইতালি প্রবাসীরা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন তাঁরা।

২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিলো ৮১ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে ১০৫ কোটি ৪২ লাখ ডলার (১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার)। প্রথমবারের মতো ইউরোপের দেশটি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।

দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রণোদনা ঘোষণা করায় দেশটির অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা আগের মতোই রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। একই কারণে যুক্তরাজ্য ও ইতালি থেকে রেমিট্যান্স রেমিট্যান্স বেড়েছে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা সবমিলিয়ে ১১ লাখের মতো। এর মধ্যে নিউইয়র্কেই থাকেন প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস।

ইউএসএ-বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক ক্লাবের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান হাসান নিউইয়র্কেই থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন নির্মাণসহ আরও কিছু ব্যবসা রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশেও ব্যবসা রয়েছে হাসানের।

উত্তরাঞ্চলের রংপুরের তারাগঞ্জে তিনি গড়ে তুলেছেন ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের অত্যাধুনিক জুতা কারখানা। বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন।

অন্য দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে হাসানুজ্জামান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা যে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, তার প্রায় পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। সে কারণেই এখন বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর পেছনে আছে বাংলাদেশ সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা। এখন যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১ শ টাকা দেশে পাঠান তাহলে তার সঙ্গে বাড়তি আড়াই টাকা প্রণোদনা পান। সে কারণেই প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন।’

হাসানুজ্জামান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। নানা পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তাঁরা। অনেকের উপার্জনও ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা পাওয়া যায় না। তবে দেশে টাকা পাঠিয়ে প্রবাসী বন্ড কিনলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা এবং বন্ড কিনে মুনাফার আশায় এখন ইউএসএ থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।’