জালিয়াতিতে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হতে পারবে

জালিয়াতিতে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হতে পারবে

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : দেশের কোনও ব্যাংকের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেলেও সরকার এতোদিন সেটিকে সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলো। সে অবস্থা আর থাকছে না। এবারে দুর্বল ব্যাংক সবল কোনও ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, অথবা দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন হবে। এমন ধারাই যুক্ত হচ্ছে ব্যাংক-কোম্পানি আইনে।

ব্যাংক খাতে এতোদিন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলতে আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করা হতো না। তাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বিষয়ে নতুন ধারা যোগ হচ্ছে আইনে। এর ফলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মাননা বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবেন না। তাঁরা কোনও পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনও পদেও থাকতে পারবেন না।

নতুন এসব ধারা সংযোজন করে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। এ নিয়ে দুই বছর ধরে কাজ চলছে। তবে চূড়ান্ত খসড়া দাঁড় করাতে সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংশোধনীর খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য (ভেটিং) আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখানে ভেটিং শেষে ফিরে এলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পরে আইন পাসের জন্য সংসদে উঠবে।

সূত্রগুলো জানায়, গত ৩১ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছিলো সর্বশেষ সংশোধন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠককালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান নি। বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিভাগটির যুগ্ম সচিব রুখসানা হাসিন বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২২ হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি।’

ব্যাংক কোম্পানি আইনের নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যাংক মনে করে যে, তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে সেটির কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। আর্থিক অবস্থা খারাপ বলতে তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা সম্ভব না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে। তার আগে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একটি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করবে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি-না দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি।

সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দেউলিয়া ঘোষণা করার বিধানও রাখা হচ্ছে আইনে। তবে বাঁচানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, প্রশাসক নিয়োগ ইত্যাদি সুযোগও রাখবে।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন যথার্থভাবেই হচ্ছে। যেসব ব্যাংক ভালো চলতে পারবে না, ব্যাংক খাতের স্বার্থেই সেগুলোকে হয় একীভূত হতে হবে, অথবা অবসায়নের পথে যেতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার উদ্যোগটিকেও আমরা স্বাগত জানাই।’

চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি :
ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তাঁকেই বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুটি করে কমিটি থাকবে। একটি কমিটি ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করবে, অন্য কমিটি তা চূড়ান্ত করে তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। এরপর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

নতুন আইন পাস হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দেবে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও হতে পারবেন না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি আইনে থাকছে জেনে ভালো লাগছে। তবে তা যথাযথভাবে করতে না পারলে সমস্যা দেখা দেবে। দেশের অনেক আইন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কার্যকর হয় না। এক্ষেত্রে যেনো সে রকম না হয়, তা আমরা আশা করবো।’

গত ১০-১৫ বছরে অবসায়ন হওয়ার মতো ব্যাংক দেখতে পেয়েছেন কি-না, যা অবসায়ন হওয়ার মতো— এ প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একবাক্যে পদ্মা ব্যাংকের নাম বলা যায় (ফারমার্স ব্যাংক)।’