ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ ও খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছে আইএমএফ

ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ ও খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছে আইএমএফ

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ এবং খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল— এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার কৌশল জানতে চেয়েছে আইএমএফ।

সংস্থাটি শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকই নয়, পুরো ব্যাংক খাতেরই খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়ে গেছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফকে বলা হয়েছে, সার্বিক খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের কমই আছে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির ৫৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া জনতা ব্যাংকের ২৮ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের অগ্রণী ব্যাংকের ১৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের সাড়ে ১৭ শতাংশ ও সোনালী ব্যাংকের ১৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ।

দুই বছরে খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলা হলেও প্রতিবছরই তা বাড়ছে এবং কীভাবে কমানো হবে, তার কোনও কৌশল ঠিক করা হয় নি বলে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন।

আইএমএফ এ ছাড়া প্রকৃত সম্পদ বোঝার জন্য খেলাপি ঋণের পাশাপাশি পুনঃ তফসিলকৃত ঋণের চিত্রসংবলিত প্রতিবেদন তৈরির কাজ ব্যাংকগুলোকে শুরু করতে বলেছে। আইএমএফ এটা বললে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে তা করা হবে।

বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার অংশ হিসেবে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় দুই সপ্তাহের বৈঠক করে গেছে আইএমএফের একটি দল। দলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে ব্যাংক খাতের উন্নয়নের ব্যাপারে যেসব কথা বলে গেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খেলাপি ঋণ।

রিজার্ভের হিসাব পরিবর্তন, বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ঋণ অবলোপনের প্রতিফলন, হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ও দেউলিয়া আইন প্রণয়ন, বছরে দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংক খাতের সামষ্টিক সহনশীলতা পরীক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ পরীক্ষা করার জন্য অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বিকাশের সময়াবদ্ধ পরিকল্পনাও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, আইএমএফের পাশাপাশি সবাই চায় খেলাপি ঋণ কমুক। কিন্তু সরকার কতোটা আন্তরিক এটা দেখতে হবে। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আগে আইএমএফ যা যা বলে গেছে, সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করলে দেশের আর্থিক খাতেরই লাভ হবে। ঋণের অর্থ আসবে, তার ব্যবহারও হবে। কিন্তু সরকারের সহি ‘নিয়ত’ না থাকলে সম্ভাব্য শর্তগুলো পূরণ হবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদে দেশের কোনও উপকারও হবে না।

ইডিএফের আকার ছোট হতে পারে : রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার এখন ৭ শ কোটি ডলার। এ থেকে ঋণ নেন রপ্তানিকারকেরা। ফেরতও দেন তাঁরা। আইএমএফ ইডিএফের আকার আরেকটু ছোট করতে বলেছে। ইডিএফের আকার ছোট থাকলে রিজার্ভের আকার বড় থাকবে—এই বিবেচনায় আইএমএফ ইডিএফের আকার ছোট রাখার কথা বলে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে ইতিবাচক। তবে কোনও সময় ঠিক করে নি এখনো।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের হিসাব করে থাকে ইডিএফের ৭ শ কোটি ডলার ও অন্যান্যসহ মোট ৮ শ কোটি ডলার যুক্ত করে। আইএমএফ বলে গেছে, প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব গণনা করতে গেলে এই ৮ শ কোটি ডলার বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী জুনের মধ্যে দুটি করে হিসাব গণনা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জী এম আবুল কালাম আজাদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, খেলাপি ঋণের হার কমানো থেকে শুরু করে আইএমএফ এমন কোনও জিনিস চাপিয়ে দেয় নি, যা পরিপালন করা সম্ভব নয়। তবে আইএমএফের চাওয়া ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মেনে নেওয়া চূড়ান্ত হবে আইএমএফের পর্ষদে।

মহামারি সহায়তা বন্ধ হোক : ব্যাংক খাতে আর মহামারি সহায়তা দেখতে চায় না আইএমএফ। সংস্থাটি চায় আগামী মাসের (ডিসেম্বর) মধ্যেই বাংলাদেশ এ সহায়তা পরিপূর্ণভাবে তুলে নিক। তুলে নিয়ে স্বাভাবিক ধারায় চলতে দিক ব্যাংক খাতকে।

জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি দেখানো হবে না— বড় শিল্পের জন্য এমন সহায়তাটি এরই মধ্যে তুলে নেওয়া হয়েছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের (সিএমএসএমই) জন্য এবং বন্যাকবলিত অঞ্চলের ঋণগ্রহীতা অর্থাৎ কৃষি খাতের জন্য সুযোগটি বহাল রাখা হচ্ছে আগামী মাস পর্যন্ত। ছয় মাসের জন্য তা বাড়ানোও হতে পারে।

দেউলিয়া আইন এবং হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন পাস করার সময় জানতে চেয়েছে আইএমএফ। কাজটি করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আইএমএফকে জানানো হয়েছে, এ দুই আইন পাস হয়ে যাবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে।

আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন : যথাযথ আর্থিক প্রতিবেদন না থাকার কারণেই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো ঘটতে পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকলেও কারও কাছে কিছু ধরা পড়ে নি। একই ঘটনা প্রযোজ্য বিলুপ্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়ে তাই প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। বলেছে, ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না এবং দুর্বলতাগুলো আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সংস্থাটি ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) অনুসরণ করতে বলেছে।

আইএমএফের দলকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের জন্য আইএফআরএস চালু করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ জন্য আইএমএফের কাছে কারিগরি সহায়তাও চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মাহমুদউল হাসান খসরু এ নিয়ে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘অর্থনীতির স্বার্থে আইএমএফের এ পরামর্শকে আমি স্বাগত জানাই। এতো দেরি অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় কেনো লাগবে আমার বোধগম্য নয়। মানলাম একটা উত্তরণের সময় এখন। মাঝখানে কোভিড-১৯ গেলো। কিন্তু প্রস্তুতি তো শুরু করতে হবে এখন থেকেই।’