পোশাকের স্বাধীনতায় আঘাতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো জাহাঙ্গীরনগর।

পোশাকের স্বাধীনতায় আঘাতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো জাহাঙ্গীরনগর।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : নারীর ‘ছোট পোশাক’-এর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেছে, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী দাঁড়ালেন পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে। নারীর নিজস্ব ইচ্ছায় পোশাক পরার অধিকারের পক্ষে পাল্টা মানববন্ধন করলেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে ভাস্কর্যের পাদদেশে রোববার (২৮ আগস্ট) বিকেলে এ কর্মসূচিতে নারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী।

বিভিন্ন পোস্টার নিয়ে ‘অসাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে আয়োজিত এ মানববন্ধনে সাম্প্রতিক সময়ে নারীর পোশাক নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করা হয় তখন।

আয়োজকদের একজন ইয়াসের সামিন এই মানববন্ধনের কিছু ছবি তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন। তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়।

ছবিতে দেখা যায়, বিভিন্ন পোস্টারে নারীর পোশাক নিয়ে তীর্যক মন্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কোনোটিতে লেখা ‘চুলের স্টাইল পুরুষকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়’, কোনোটিতে লেখা, ‘খালি গায়ে থেকে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন’।

এর আগে সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাদদেশে আরেক দল শিক্ষার্থী নারীর ‘ছোট পোশাকের’ বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন করেন। কয়েকজন পুরুষ শিক্ষার্থীর করা ওই কর্মসূচিতে দাবি করা হয়, ‘পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরা মেয়েরা পুরুষকে মানসিকভাবে ধর্ষণ করেন।’

ওই মানবন্ধনে একটি ফেস্টুনে লেখা ছিল, ‘সম্মতি ছাড়া সিডিউস করা মানসিক ধর্ষণ।’

এ ব্যাপারে বাংলা বিভাগের ৪৮তম আবর্তনের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার ইমন ওই মানববন্ধন থেকে বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে মানুষকে সিডিউস বা যৌনতায় প্ররোচিত করে এমন পোশাক পরা অন্যায়। কাউকে যৌনতায় উদ্বুদ্ধ করতে অবশ্যই তাঁর সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কারও সম্মতি ব্যতিরেকে তাঁকে যৌন প্রলুব্ধ বা প্ররোচিত করা এক ধরনের মানসিক ধর্ষণ।’

একই দিন নারীর পোশাকের স্বাধীনতা বিরোধী মানববন্ধন হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলো, ‘পাবলিক প্লেস আর প্রাইভেট প্লেসের পোশাক কখনও এক নয়’, ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধর্ষণপ্রবণ রাষ্ট্রগুলোতে নারীরা ছোট পোশাক পরে’, ‘যাদের নাই কমনসেন্স, ছোট পোশাকে তারাই করে নুইসেন্স’, ‘জ্ঞান বিজ্ঞান আমদানি করুন, অশ্লীল পোশাক নয়’, ‘উচ্চ আদালত নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিচার চাই’ প্রভৃতি।

এর আগে শনিবার বিকেলে রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েও হয় এমন মানববন্ধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেটের পাশে ‘নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে এর আয়োজন করা হয়।

পোশাকের স্বাধীনতাবিরোধী এই মানববন্ধনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গত বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বহিরাগতও ছিলেন বলে বাঙলা কাগজ ও ডনের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্যানটিন কর্মী মো. ফজলে রাব্বি বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, তিনি সেদিনের কর্মসূচির বিষয়বস্তু এবং ফেস্টুনের লেখা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ঘটনাস্থল দিয়ে যাওয়ার সময় আয়োজকেরা তাকে ডেকে নিয়ে হাতে ফেস্টুন ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছেন।

সেদিন মানববন্ধনের একেবারের শেষ প্রান্তে ফেস্টুন হাতে দাঁড়ানো কালো শার্ট পরা রাব্বির ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রাব্বির হাতে থাকা ফেস্টুনে লেখা ছিলো, ‘ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন।’

যে ঘটনায় এসব মানববন্ধন : স্লিভলেস টপ পরা এক তরুণীকে নরসিংদী রেলস্টেশনে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার মার্জিয়া আক্তার শিলাকে জামিন দেওয়ার সময় হাইকোর্টে এক বিচারকের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৬ আগস্ট মার্জিয়াকে ছয় মাসের জামিন দেন।

মার্জিয়ার আইনজীবী মো. কামাল হোসেনের বরাতে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শুনানির সময় আদালত দেশের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তরুণীর পোশাক সঙ্গতিপূর্ণ কি-না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ওই তরুণী যে পোশাক পরেছিলেন, সেটি দেশের সবচেয়ে ‘ফাস্ট এরিয়া’ গুলশান-বনানীতেও কোনও মেয়ে পরে রাস্তায় বের হন না বলেই আদালত মন্তব্য করেছেন।

সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তুমুল সমালোচনা সৃষ্টি হয়। মার্জিয়ার আইনজীবী কামাল হোসেন ১৭ আগস্ট এ বিষয় হাইকোর্টের একই বেঞ্চের নজরে এনে সমালোচনাকারীদের শাস্তি দাবি করেন।

এ সময় আদালত ফেসবুকে মন্তব্যকারীদের বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে স্ক্রিনশট জমা দিতে বলেন। পাশাপাশি হাইকোর্ট বেঞ্চটির জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘আমরা তো আদেশে পোশাক নিয়ে কিছুই লিখি নি, আমরা ভিডিও দেখে আইনজীবীদের কাছে শুধু জানতে চেয়েছি। ভিডিও দেখে রাষ্ট্রের কাছে জানতে চেয়েছি, এমন ড্রেস পরে এমন গ্রাম এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কি-না।’

এদিকে মার্জিয়াকে হাইকোর্ট জামিন দিলেও পরে তা স্থগিত করেন চেম্বার আদালত।