প্রসঙ্গ : আ.লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গিবাদ এবং বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট

প্রসঙ্গ : আ.লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গিবাদ এবং বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট

কালাম আঝাদ'র কলাম :: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সরকার পতন হয়েছে, সেটা দেশের জন্য ভালো। এখন আমাদের সবার আগে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে, সুষম উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সুসংহত ও গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্রের দিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু শত শত ছাত্রের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত নতুন ভোর যদি কালিমায় লেপন হয়; তাহলে সেটা কি মঙ্গল হবে? মঙ্গল হবে না। কারণ আমরা এখন দেখছি, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও জামায়াত-শিবিরকে ব্যাপক আকারে কাভারেজ দিচ্ছে; যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। হ্যাঁ, স্বাধীন দেশে সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে, তবে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হতে হবে অবশ্যই। এরপর দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার পতনের পর একে একে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যেমন জামিন দেওয়া হচ্ছে, তেমন জঙ্গিদেরও জামিন দেওয়া হচ্ছে। আমি বলবো এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নেই। কারণ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগই তো দেশকে অস্থিতিশীল করানোর চেষ্টা করতে পারে। আর জঙ্গিদের ওপর নজরদারি কমে গেলে এবং যাঁরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাঁদেরকে এভাবে হয়রানি করা হলে তো জঙ্গিরা আস্কারা পেয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে; যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কখনোই কামনা করতে পারে না। এরপরের বিষয় পঁচাত্তরে যেমন আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো, তেমনি ২০০৮ সালের পর বিএনপির নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। যা এখন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে হচ্ছে। বিষয়টি হলো : পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখল করা খুনিরা বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে এবং আওয়ামী লীগকে নিয়ে ভীত ছিলো। তাদের ধারণা ছিলো, তখন কোনোভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় চলে আসলে তাদের বিচার করা হবে; অথচ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কিন্তু বিচার করা হয়েছে; সেটা ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে। এরপর ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ যা করেছে, তা হলো শেখ হাসিনা যতোদিন বেঁচে থাকেন, ততোদিন যাতে ক্ষমতায় থাকেন; তা নিশ্চিত করা। এ কারণে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এর নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয় নি। ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো। ২০০৮ এর পর আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বা পুরোনো মামলার রায় দিয়ে, গুম করে, খুন করে, হামলা করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো। ওই যে পঁচাত্তরে এক প্রকার 'বিএনপি' আওয়ামী লীগকে এবং ২০০৮ এর পর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ঘৃণ্য প্রয়াস জোরালোভাবে চালিয়েছে; সেটারই আজকের ফল এই জামায়াত-শিবিরের উত্থান এবং জঙ্গিদের জামিন পাওয়া। আমি বলছি না যে, বাংলাদেশের যে কোনও নাগরিকেরই রাজনীতি করার অধিকার নেই; আমি বলছি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে রাজনীতি করা যাবে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলে আমি দেশই মানলাম না, তাহলে আমি সেই দেশে রাজনীতি করি কি করে? এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি করা যাবে না। এখন জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে আসা যাক, খুবই দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করেছেন, তাঁদেরকে চাকরিচ্যুত তো করা হচ্ছেই, আবার তাঁদেরকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে, এমনকি রিমান্ডেও নেওয়া হচ্ছে। আমাদের একটি কথা ভাবতে হবে, দেশের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সরকার পতন ঘটিয়েছে। তার মানে যে শুধু দলীয় চাঁদাবাজ পরিবর্তন হবে তা নয়। অর্থাৎ সরকার পতনের এখন বিএনপির নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করবে তা নয়। যা অনেক জায়গায় চলছেও। আবার এটিও নয় যে সরকার পতনের পর বিএনপি বা জামায়াত ক্ষমতায় চলে গেছে। বরং নতুন যে কোনও দলও ক্ষমতায় যেতে পারে। এমনকি নতুন করে গঠিত কোনও দলও। আবার বিএনপি-জামায়াতও ক্ষমতায় যেতে পারে; যেতে পারে আওয়ামী লীগও। এখন কেউ কেউ হাসবেন। কেনো? নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে, তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে জনগণ যদি মনে করে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলই ভালো ছিলো, তবে তাঁরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে (যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়); তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে; সেবার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নাও তো হতে চাইতে পারেন, নতুন কোনও ফ্রেশ মুখও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। যদিও এখন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমি এ কথাটা বললাম এ কারণে যে, পঁচাত্তর এবং ২০০৮ এর পর যে ভুলগুলো হয়ে আসছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও যদি একই ভুল করে তবে পস্তাতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সকল দুর্নীতিবাজদের প্রতিপক্ষ মনে না করে শুধু আওয়ামী লীগকেই প্রতিপক্ষ মনে করে; তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আবার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকাদের বিচার করবে। তাই বলে আমি (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) এখন মানবতাবিরোধী দল বা গুম, খুনের দল বলে নিজে বাঁচার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে নিষিদ্ধ করে দেবো, তা নয়। তাহলে ১৯৭৫ এর পর আওয়ামী লীগ যেমন ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে বিচার করেছে, আবার বিএনপি হয়তো ২০ বছর পর (আনুমানিক ২০২৮ যদি হয় এবং যদি ক্ষমতায় আসে) ক্ষমতায় এসে বিচার করবে; তেমনি আওয়ামী লীগ কিন্তু এরপর ক্ষমতায় আসলে চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে বিচার করবে। সুতরাং আমরা দেশটাকে ভালো রাখার স্বার্থে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে সুসংহত গণতন্ত্র উপহার দেবো, এটাই হোক আমাদের প্রত্যয়। নতুবা হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি চলবে আর ফায়দা লুটবে অন্যরা, আর আমরা পাবো আন্ডা (এবং ডাণ্ডা)।