প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি সহজভাবে হস্তান্তর করুন।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি সহজভাবে হস্তান্তর করুন।
বাসস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রযুক্তির সহজলভ্য ও পর্যাপ্ত হস্তান্তর নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ফোরআইআর) সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। তিনি বলেন, সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়োপযোগী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলেকো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে,যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য হয়, তাহলে সেটা সম্ভব হবে’ তিনি গণভবন থেকে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে’র সমাপনী অনুষ্ঠানে শনিবার (১১ ডিসেম্বর) ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে একথা বলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১০ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক দুই দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পায়ন আমাদের প্রয়োজন। আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষি ভিত্তিক। কিন্তু সাথে সাথে শিল্পায়নও আমাদের প্রয়োজন। কাজেই কৃষি এবং শিল্প দুটোই আমাদের প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের নিতে হচ্ছে। তা ছাড়া আমরা বিশ্বে দেখি প্রতি শত বছর পর পর শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন বিবর্তন দেখা দেয়। এই বির্তবনের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় ইতোমধ্যে অতিক্রম হয়েছে। এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। সেটা লক্ষ্য রেখে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী এবং সবুজ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টির উদ্দেশে পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে- একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী ও সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী উন্নত দেশগুলো এবং অন্যদিকে এসব ক্ষেত্রে যারা বিনিয়োগে সক্ষমতা রাখে না সল্পোন্নত বা অন্যান্য দেশগুলো। কাজেই এই বিষয়টা আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মাথায় রেখে প্রযুক্তি যেন সকলে সমান ভাবে ব্যবহার করতে পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে এটা আমাদের উন্নত দেশগুলোর একটা দায়িত্ব রয়েছে এক্ষেত্রে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যেমন- মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে, সস্তা শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তিজ্ঞান ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে, যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য হয়, তাহলে সেটা সম্ভব হবে। আর যদি না হয় তাহলে বৈষম্য থেকে যাবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ ও সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন। অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও উপস্থাপন করা হয়। শীঘ্রই ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করা হবে জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ৫-জি চালু হলে তা ব্যবসা ক্ষেত্রেই সবচেয়ে কাজে লাগবে। এটা ব্যবসার মডেল, শিক্ষা-পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান এবং প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি অতিক্রম করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের নেয়া বিভিন্ন বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অ্যাসেমব্লি, সফট্ওয়্যার তৈরিতে এবং ডাটা-প্রসেসিং কাজে দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রযুক্তিক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভবনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা অটোমেশন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছি। আমি বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প আমাদের রপ্তানি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে। হাইটেক পার্কগুলোতে নামী দামী আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ আসছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে গবেষণা-উন্নয়ন এবং উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছি। যার ফলে এই ক্ষেত্রে আমাদের আইটি পার্কগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ছে। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে বিনিয়োগ করছে। যেমন- নোকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়েসহ অনেক কোম্পানি এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার উৎপাদন খাতে ‘বৃত্তিয় অর্থনৈতিক মডেল’ গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, যার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ, পুনঃব্যবহারযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পণ্য উৎপাদন শুরু করেছি। হাইব্রিড গাড়ী আমদানীতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া এবং বৈদ্যুতিক গাড়ী চালুর কাজ শুরু করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে বিনিয়োগও আসছে। তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশের শিল্পোন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেয়া নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরার পাশপাশি দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘৭৫’র বিয়োগান্তক অধ্যায়ের দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের পূণরায় রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণকালীন দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারী ছিল না। প্রধানমন্ত্রী বলেন,তাঁর সরকারই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করে। অবকাঠমো গড়ে তোলা,বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ নাগরিক সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করে। আর এক্ষেত্রে তাঁকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাঁর ছেলে এবং সরকারের তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সৃষ্টি করাতেও তার (সজীব ওয়াজেদ জয়) সহযোগিতা এবং উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী । সরকার প্রধান বলেন, জয় এর কাছ থেকেই তিনি কম্পিউটার চালানো শিখেছেন এবং তারই পরামর্শ ছিল ট্যাক্স না কমালে কম্পিউটার কেউ কিনতে পারবে না। আর ব্যবহারও করবে না। পরবর্তীতে ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সে ট্যাক্স তুলে দেয়। বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সম্ভবনা থাকার পরও প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ পিছিয়ে গিয়েছিল বলেও আক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ’৯১ পরবর্তী বিএনপি’র শাসমনালে যখন এই অঞ্চলে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগের সুযোগ আসে বাংলাদেশ তখন বিনামূল্যে ফাইবার অপটিকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার একটা সুযোগ পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিল যে, এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যাবে না। কারণ আমাদের সব তথ্য নাকি বের হয়ে যাবে (তথ্য পাচার)। এই জন্য সেই ফাইবার অপটিকসের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হয়নি। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্য। পরে অনেক বেশি টাকা খারচ করে এই ফাইবার অপটিক সংযোগ স্থাপন করতে হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তথ্য প্রযুক্তি সেবাকে জনগনের কাছে পৌঁছে দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তিতে রূপান্তর করতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, এখানে নতুন কর্মসংস্থান যেটা হবে তার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষ যেন তাল মিলিয়ে চলতে পারে,দেশের যুব সমাজকে আমরা সেভাবেই একেবারে ছোট থেকেই সে শিক্ষা দিতে চাই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ.আই),রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হব বলে আমি বিশ্বাস করি। কারন আমাদের ছেলে-মেয়েরা অত্যন্ত মেধাবী, বলেন তিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর এখন বাংলাদেশ ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং উন্নত,সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,আমাদের যেটা লক্ষ্য ছিল রুপকল্প ২০২১ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে আমরা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত,সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ ইনশাল্লাহ আমরা গড়ে তুলবো। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটা নেতৃত্ব দানকারী দেশ। যারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পউদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করেন। ৩ জন নোবেল বিজয়ী এবং ৬ জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। দুটি সাইড ইভেন্ট ‘মুজিব-১০০ আইডিয়া কনটেস্ট’এবং ‘মুজিব-১০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিট’ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭টি দেশ থেকে মোট ৫২৫টি গবেষণাপত্র জমা হয়েছে এবং তার মধ্য থেকে ১০০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এ ছাড়া সহস্রাধিক আইডিয়া থেকে ১০টিকে সেরা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে,যারা প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার পাবেন।