নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর রুটে বাসের জন্য নেওয়া হচ্ছে বিশেষ বিআরটি প্রকল্প।

নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর রুটে বাসের জন্য নেওয়া হচ্ছে বিশেষ বিআরটি প্রকল্প।
ডন প্রতিবেদন : নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া থেকে সাইনবোর্ড, ডেমরা, বনশ্রী, মাদানী অ্যাভিনিউ, আফতাবনগর, পূর্বাচল, মীরেরবাজার, পূবাইল এবং রাজেন্দ্রপুর হয়ে কাপাসিয়া পর্যন্ত দ্রুত বাস চলাচলের পথ (বিআরটি) নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরইমধ্যে ৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশেষায়িত এ পথের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছে। এটিকে বলা হচ্ছে বিআরটি-৭। সমীক্ষা অনুযায়ী, ১০ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে এবং তার মাঝ বরাবর বিআরটি লেন নির্মাণে ৪ হাজার ৪৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ৩৪ হাজার ৪ শ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিআরটি লেন নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৮ হাজার ৪ শ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়বে ১০৯ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা লাগবে ১০ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে। চার ধাপে ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালেরমধ্যে বিআরটি-৭ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নকশায় দেখা যায়, যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হবে দুই পাশে তিন লেন করে ছয় লেনের। ২১ মিটার বা প্রায় ৬৯ ফুট প্রশস্ত এই এক্সপ্রেসওয়েতে চলতে টোল লাগবে। তবে এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে ৭ মিটার প্রশস্ত দুই লেন করে মোট চার লেন সড়ক থাকবে টোল ছাড়া যান চলাচলের জন্য। এর পাশে থাকবে অযান্ত্রিক যান (রিকশা, সাইকেল ইত্যাদি) চলাচলের জন্য দুই দিকে আড়াই মিটার করে লেন। তারপর দুই দিকেই পথচারীর জন্য আড়াই মিটার প্রশস্ত ফুটপাথ। প্রায় পাঁচ কোটি টাকায় করা এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিআরটি ও এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫ হাজারসহ সবমিলিয়ে ঘণ্টায় ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিআরটি লেনের মাঝে পাঁচ মিটারের সড়ক বিভাজকসহ এক্সপ্রেসওয়ে ৫৭ দশমিক ৫ মিটার বা ১৯০ ফুট প্রশস্ত হবে। দুইপাশে ৩০ ফুট করে জায়গা খালি রাখা হবে। সবমিলিয়ে এটি ২৫০ ফুট প্রশস্ত হবে। আর এজন্য ১ হাজার ২৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে ৮১টি বিআরটি স্টেশন থাকবে। ১৫টি ট্রানজিট ইন্টারচেঞ্জ ও ছয়টি মহাসড়ক ইন্টারচেঞ্জ থাকবে। এরমধ্যে ১৮টি হবে গ্রেড সেপারেটেড ইন্টারচেঞ্জ। মাঝে রাখা পাঁচ মিটারের বিভাজকে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল নির্মাণ করলে ঘণ্টায় ৮০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। জমি অধিগ্রহণকে প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমীক্ষায়। নির্মাণ ব্যয় কমাতে জমি অধিগ্রহণ না করে প্রকল্প এলাকার ভূমি মালিকদেরসঙ্গে অংশীদারিত্বে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিআরটি স্টেশন এলাকায় ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বাণিজ্যিক স্থাপনা অবকাঠামো থাকবে টিওডিতে। সরকার ও ভূমি মালিকেরমধ্যে তা ভাগ হবে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-১ ও এমআরটি-৫-এর স্টেশন এলাকার জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলারে। এতে জমি মালিকেরা লাভবান হলেও সরকার বর্ধিত দামের মাত্র ৪ শতাংশ পেয়েছে। বিনিয়োগ দ্রুত তুলে আনতে বিকল্প হিসেবে বলা হয়েছে, বিআরটি করিডোরের দুইপাশে ৫ শ মিটার করে এক কিলোমিটার এলাকায় উন্নয়ন কর নির্ধারণ করা যেতে পারে। ফলে জমি মালিকদেরসঙ্গে সরকারেরও লাভ হবে। টিওডি নির্মাণ ছাড়াও স্টেশন ও ইন্টারচেঞ্জ এলাকার ভূমি উন্নয়নেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এলাকায় উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সাইনবোর্ড ও ডেমরা এলাকায় ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণে বর্তমান বাজারদরে দেড় হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ৪৫ শতাংশ ভূমি রেখে বাকি জমি ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকায় প্লট আকারে বিক্রি করা সম্ভব। এতে সরকারের দুই হাজার ৬১৮ কোটি টাকা লাভ হবে। জমি অধিগ্রহণ ও তা উন্নয়নই মূল চ্যালেঞ্জ- এ কারণে পূর্ব অভিজ্ঞতায় রাজউকের মাধ্যমে বিআরটি-৭ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে সমীক্ষায়। ২০১৫ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) রাজধানীর যানজট নিরসনে পাঁচটি মেট্রো রেললাইন এবং দুটি বিআরটি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে কেরাণীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার বিআরটি-৩-এর অর্ধেক, অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণকাজ চলছে। ১০ বছরেও তা শেষ হয় নি। নির্মাণ ব্যয় ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে যাচ্ছে। নির্মাণকাজে টঙ্গী-জয়দেবপুর সড়ক যানজটে প্রায় প্রতিদিন স্থবির থাকছে। আরএসটিপিতে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের কম জনবসতিপূর্ণ এলাকার নগরায়ণ এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী যোগাযোগ বাড়াতে গাজীপুরের পূবাইল থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার বিআরটি-৭ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নযোগ্য কিনা, তা যাচাইয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ২০১৮ সালে সরকারি অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করে। ব্রিটিশ পরিবহন প্রকৌশলী রবার্ট গেলাঘেরের নেতৃত্বাধীন দল এ সমীক্ষা করে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর সড়ক পরিবহন সচিবের সভাপতিত্বে সভা হয়েছে। এতে প্রকল্পের অর্থায়ন, বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়। সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, সমীক্ষার কাজ শেষ। বৈদেশিক ঋণের অর্থায়ন পাওয়া সাপেক্ষে এই প্রকল্পটি এগোবে। কোন সংস্থা করবে, তা নির্ধারণসহ অনেক কাজ বাকি রয়েছে। এসব শেষে সরকারের অনুমোদন পেলে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নসহ বিআরটি-৭ বাস্তবায়নের পর্যায়ে যাবে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই পথে (অ্যালাইনমেন্ট) বিআরটি-৭ হলে তা ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যুক্ত হবে। ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নগরায়ণ হবে। তুলনামূলক কম জলাভূমি ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই অ্যালাইনমেন্টে মেট্রোরেল লাইন না করে বিআরটি-৭ নির্মাণের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেলের চেয়ে বিআরটির যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা কম হলেও নির্মাণ ব্যয়ও অনেক সস্তা। ৭৭ কিলোমিটার বিআরটি-৭ নির্মাণে সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। কিন্তু ২৪ কিলোমিটার এমআরটি-১ নির্মাণে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ও ২০ কিলোমিটার এমআরটি-৫ নির্মাণে সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা লাড়ছে। ২০২৪ সালেরমধ্যে নির্মাণাধীন ৬ লেনের লিঙ্ক রোড হয়ে চাষাঢ়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত বিআরটি লেন ও এক্সপ্রেসওয়ে ব্যয় হবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২০২৬ সালেরমধ্যে সাইনবোর্ড থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটি লেন নির্মাণে লাগবে ৮ হাজার ২ শ কোটি টাকা। ২০২৭ সালেরমধ্যে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি নিতে দরকার হবে ১১ হাজার ৭ শ কোটি টাকা। ২০৩০ সালেরমধ্যে কাপাসিয়া পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি নিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, বিআরটি-৭ দ্রুত ও কম টাকায় নির্মাণ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ‘বিআরটি-৩ নির্মাণে যে দুর্ভোগ হচ্ছে, তেমন যেনো না হয়।’