নিপীড়নমূলক হিন্দু আইন থেকে মুক্তি চান নারীরা।

নিপীড়নমূলক হিন্দু আইন থেকে মুক্তি চান নারীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : বৈষম্যমূলক হিন্দু আইনের শিকার ডা. মায়া হোর বলেন, আমি আমার জীবনে জেলা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। মেডিক্যালের তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় বিয়ে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি আমার পড়ালেখায় বাধা হয়ে দাঁড়ান। তখন থেকে আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম, আমাকে আমার পড়াশোনা চালাতে হবে। বিসিএস দিতে দেবে না। ২০০৫ সালে চাকরিতে যোগদান করি। আমার স্বামী ওই বছরের আগস্টেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। হিন্দু আইনে বহুবিবাহে বাধা নেই। তখন থেকে আমি একা আছি। আমি বিয়ে করলে সেটা আইনের চোখে অবৈধ হবে এবং আমার সন্তানেরাও অবৈধ হবে। তাঁরাও অধিকার পাবে না।

‘আমি একজন ডাক্তার। আমি আমার নিজের উপার্জনে যদি নিজের নামে কোনও সম্পত্তি করি, তবে সেটা বিক্রি করতে গেলে আমার স্বামীর অনুমতি লাগবে। অথচ তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কই নেই। আমার সেই সম্পত্তিতে অধিকার পাবে আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র-সন্তান। আমার বিশ বছরের একটি মেয়ে আছে। তাঁকে আমি মানুষ করছি। সে অধিকার পাবে না। ফলে আমি নিজের নামে সম্পদ করতে পারছি না, কিছু করতে গেলে সরাসরি আমার মেয়ে নামে কিনতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র করার দরকার। সেখানে বাবার নাম লাগবে। এজন্য সে তাঁর বাবার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়েছে, কিন্তু তিনি সেটি দেন নি। হিন্দু আইনে শুধু মেয়েরা নন, ছেলেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হিন্দু আইনের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

ভিকটিম মুক্তা শেরপা তাঁর জীবনের করুণ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের আইন না থাকায় প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হিন্দু মেয়েরা পুনরায় বিবাহ করতে পারছে না। আইনকে পাশ কাটিয়ে পুনরায় বিয়ে করলে তাঁদের যে সন্তান সন্ততি হবে, তাঁরাও আইনের চোখে অবৈধ এবং অধিকারহীন হয়ে যায়।

ভিকটিম তুলি রানী বলেন, ‘আমার যখন ২০ বছর বয়স, তখন আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দেয়। আমাদের বিয়ের ভয়ঙ্কর বিষয়টা হচ্ছে যৌতুক প্রথা। বিয়ের ছয় মাস পরে যৌতুক দাবি করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বের হয়ে আসি। বাবা-মা বলেন, হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই, মরতে হলে, ওখানেই মরতে হবে। বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন করতে গেলে বাচ্চার বাবার জন্ম নিবন্ধন চায়। ওর জন্মের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কেনো মেয়েরাই শুধু স্ট্রাগল করবে?’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোমা রায় বলেন, হিন্দু আইন ভারত পরিবর্তন করেছে, শ্রীলঙ্কা করেছে, এমনকি ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশও হিন্দু আইন পরিবর্তন করেছে, তাহলে বাংলাদেশ কেনো হিন্দু আইন পরিবর্তন করবে না?

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নারী শাখা মহিলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি সুপ্রিয়া ভট্টচার্য বলেন, গরিব মানুষের মেয়ে সন্তান হতে নেই। আমাদের এক কর্মচারী তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মেয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ। কিন্তু যৌতুকের হাত থেকে রেহাই পায় নি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, বিদ্যমান প্রথাগত হিন্দু আইন শুধু বৈষম্যমূলক নয়, এগুলো অমানবিক এবং বর্বরতাপূর্ণ। 

‘সন্তান হিসেবে আপনার ছেলে এবং মেয়ের সমান অধিকার আছে কিনা? আপনি আপনার সন্তানের সমান অধিকারে বিশ্বাস করেন কিনা? আমি স্পষ্ট করে বলছি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সমান অধিকার দেওয়াই সভ্যতার দাবি।’

বক্তারা শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন।

হিন্দু নারীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের কেউ কেউ বলেছেন হিন্দুরা সবাই একমত হয়ে আসেন, তারপর হিন্দু আইন সংশোধন হবে। এ ধরনের কথা মূল্যহীন। বাংলাদেশে এমন একটি আইনও নেই, যা প্রণয়নের সময় সকল নাগরিককে একমত হতে হয়েছে। এমন কোনও আইন নেই, যে বিষয়ে সবাই একমত। তাই এসব বলে লাভ নেই। অধিকার এবং বঞ্চনার অবসানের জন্যই হিন্দু আইন সংস্কার করতে হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে অনেক আন্তরিক। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হলে এই আইন করা সম্ভব। আমার সম্পত্তিতে আমার ছেলে-আমার মেয়ে সবাই অধিকার পাবে। আপনারা কাজ করেন। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। 

বিদ্যমান হিন্দু আইন সংস্কার ছাড়া নারীর প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেই মত প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। 

তিনি বলেন, এখানে হিন্দু নারীরা যে বঞ্চনা ও অধিকারহীনতার কথা বলছেন, তা বাস্তব হলেও একজন বিচারক হিসেবে এর প্রতিকার দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। হিন্দু নারীদের এই বেদনা আমি উপলব্ধি করি। কিন্তু একজন বিচারক হিসেবে আমাকে আইন অনুযায়ী চলতে হয়। আইন আপনাকে অধিকার দেয় নি, আমি কীভাবে দেবো? আমিও আমার বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাই নি। তাই হিন্দু আইন সংশোধন দরকার এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

আগামী অক্টোবরে নিজের অবসরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে কৃষ্ণা বলেন, আমি খুব দ্রুত মুক্ত জীবনে চলে যাবো। তখন আপনাদের একজন হিসেবে আপনাদের সঙ্গে থেকে হিন্দু আইন সংস্কারে কাজ করবো।

‘প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ডাক, লিঙ্গবৈষম্য নিপাত যাক’ স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ড. ময়না তালুকদার বলেন, সনাতন ধর্মে বৈদিক যুগে নারীদের উপর এই বঞ্চনা ও অধিকারহীনতা ছিলো না। এ ধরনের বঞ্চনা সনাতন ধর্ম সমর্থন করে না।

‘বৈদিক যুগে হিন্দু পরিবারে বাবা-মার সম্পত্তিতে নারীদের পূর্ণ অধিকার ছিলো। হিন্দু আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেই অধিকার পুনর্বহাল করতে হবে।’

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক।

সংগঠনটির সহ-সভাপতি সুভাষ সাহা বলেন, হিন্দু আইনে একটি নারীর জীবন হলো জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরুষের অধীনস্ত ও আশ্রিত হয়ে থাকতে হবে।

আলোচনা সভায় বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ঝনা বাড়ৈ বলেন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারী হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সমাজে। পুরুষরা কিন্তু একা চলতে পারেন না। আমরা নারী, আমরা সবকিছু করার যোগ্যতা রাখি। তাহলে আমরা কেনো পিছিয়ে থাকবো?

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি বলেন, আমার কর্মজীবনে বহু হিন্দু নারীর অবস্থা ও আইনগতভাবে প্রতিকারহীনতা প্রত্যক্ষ করেছি। আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মেয়েদের অধিকারের জন্য হিন্দু আইন পরিবর্তন করা দরকার। 

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, ভারতে আইন পরিবর্তন হয়েছে, তাঁরা অনেক কিছুই মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমার এখানে পরিবর্তন এখনও হয় নি। আমাদের দেশেও পরিবর্তন হবে, তবে কবে হবে বলতে পারি না।

আলোচনা সভায় বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাসগুপ্ত, সমাজকর্মী কাজল দেবনাথ বলেন এবং হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সহ-সভাপতি রিনা রায় প্রমুখ বক্তব্য দেন।