তালেবান কি হেরোইনের অর্থ ছাড়া টিকতে পারবে?

তালেবান কি হেরোইনের অর্থ ছাড়া টিকতে পারবে?
ডন প্রতিবেদন : গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে হেরোইনের উৎপাদন বেশ বেড়েছে। এই মাদক তালেবানের তহবিল গঠনের বড় উৎস। এখন তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তারা দেশটিকে ‘মাদকমুক্ত’ হিসেবে গড়ে তুলবে। কিন্তু তারা আদৌ এই লাভজনক ব্যবসা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) তালেবানের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ আফিমের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তানকে নতুন সরকার অন্যান্য ফসলের রাজ্যে পরিণত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ‘একদিকে তারা অনেক উদার এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে অনেক বেশি আগ্রহী- এমন ইমেজ তৈরি করতে চাচ্ছে। এ জন্য মাদক অন্যতম পন্থা বলে তারা বুঝতে পেরেছে। অন্যদিকে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করলে তালেবানের রাজনৈতিক ভূমি হেলমান্দ ও কান্দাহার প্রদেশে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে গেলে তালেবানকে বেশ বেগ পেতে হবে।’ মাদকের একচেটিয়া আধিপত্য : তালেবান মুখপাত্র মুজাহিদ সংবাদ সম্মেলনে কৃষকদের পপির বদলে অন্য ফসল চাষে উৎসাহিত করতে ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা’ চেয়েছে। ১০ বছর ধরে ন্যাটো জোট, বেসরকারি সংস্থা ও জাতিসংঘের কর্মীদের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের কাছে তালেবানের ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতার’ আহ্বান এক ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু না। কারণ, তাঁরা আফগানিস্তানের পপি চাষের ওপর নির্ভরতা কমাতে যে চেষ্টা করে গেছেন, তা ব্যর্থ হয়েছে তালেবানের কারণেই। মার্কিন স্পেশ্যাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তানের ২০১৮ সালের তথ্যমতে ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মাদক বাণিজ্যের বিরুদ্ধ লড়াইয়ে ৮৬০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ছিল কৃষকদের গম ও জাফরান উৎপাদনে উৎসাহিত করা, পরিবহন খাতে বিনিয়োগ, শষ্যের ওপর কিটনাশক প্রয়োগ ও পরিশোধন স্থাপনার ওপর বোমা বর্ষণ। কিন্তু তালেবাননিয়ন্ত্রিত যেসব অঞ্চলে পপি বেশি চায় হয়, সেসব এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ তালেবান যোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন ও আফগান সরকারের হিসাবে, তালেবান এই খাত থেকে শত শত মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, তালেবাননিয়ন্ত্রিত এলাকার স্থানীয় ওয়ারলর্ডস ও যোদ্ধারা প্রায়ই কৃষকদের পপি চাষ করতে চাপ দিতেন। ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) তথ্যমতে, এই দেশ আফিম ও হেরোইন চাষে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করে আসছে। বিশ্বের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ আফিম এখান থেকে আসে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে পপি চাষ হয়। গত চার বছরে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে পপি চাষ হয়েছে। ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় এই উৎপাদন প্রায় চার গুণ। জাতিসংঘের তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। তালেবানের হাতে মাদকের বিশাল মজুত : কিন্তু নতুন সরকারের মাদকনীতি বিশ্বে হেরোইনের বাজারে ব্যাপক দাম বাড়বে। পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও চীনে এর প্রভাব পড়বে। এগুলো মাদক পাচারের বড় বড় রুট এবং এসব দেশে আফগান মাদকের বিশাল বাজার রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পপির মতো পাচারকারীরা আফগানিস্তানে আরেকটি মাদকের সন্ধান পেয়েছে। এর নাম ইফিড্রা। মেথামফেটামিন তৈরিতে এটি অন্যতম উপাদান, যা ‘ক্রিস্টাল মেথ’ নামে পরিচিত। কট্টরপন্থি এই গ্রুপ মাদক বাণিজ্যকে অবৈধ ঘোষণার প্রতিজ্ঞা করেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বানিহীর হাতে এই বাহিনী উৎখাত হওয়ার আগমুহূর্তে ২০০০ সালে দেশটিতে মাদক উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। ‘সিডস অব টেরর : হাউ হেরোইন ইজ ব্যাংকরোলিং দ্য তালেবান অ্যান্ড আল-কায়েদা’ বইয়ের মার্কিন লেখক গ্রেচেন পিটার্স বলেন, পপি চাষের ওপর তালেবানের আগেকার নিষেধাজ্ঞা ছিল কৌশলগত। তিনি বলেন, তারা ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছে। এটি তাদের একটি চাল, তাদের কাছে মাদকের প্রচুর মজুত রয়েছে। এবার এই মাদকের দাম ১০ গুণ বাড়ার ফলে তারা ব্যাপক অর্থ বাগিয়েছে। তারা এই মাদক বাণিজ্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না। কারণ, এর সঙ্গে তারা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই মাদক চাষ থেকে জীবিকা নির্বাহকারী গরিব চাষিদের কথা উল্লেখ করে পিটার্স বলেন, ‘আফগানিস্তান আফিম ছাড়া টিকতে পারবে না। এটি আফগানিস্তানকে শেষ করার পাশাপাশি দেশটির অনেক মানুষকে বাঁচিয়েও রাখবে। দেশটিতে এখন তালেবানের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের পক্ষে মাদক ও অর্থ পাচার সহজ হয়ে পড়বে এবং তারা যে এটি করবে, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’