কেমন আছে রূপালী ব্যাংক

কেমন আছে রূপালী ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি)- এ চার চলকের দিক থেকেই খারাপ অবস্থানে আছে রূপালী ব্যাংক। এক্ষেত্রে অনিয়ম এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই মূল কারণ। দেখা গেছে, অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ প্রদান, তারপর সে ঋণ আদায় করতে না পেরে খেলাপি হচ্ছে। আর সেই খেলাপি যখন খারাপ অবস্থায় অর্থাৎ মন্দ অবস্থায় বা আদায় অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যাংকের ক্ষতি হচ্ছে সম পরিমাণ টাকা। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই এসব আদায় অযোগ্য ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানো হচ্ছে। যা হয়েছে রূপালী ব্যাংকের বেলায়। সার্বিকভাবে অনিয়মের কারণে আর্থিক দিক থেকে খারাপ অবস্থায় থাকা রূপালী ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন গভর্নর। এক্ষেত্রে মোট ৯টি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে গত ছয় বছরে রূপালী ব্যাংকের ঋণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে তিনগুণ। অথচ ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে ঋণ খেলাপি হওয়া স্থগিত রেখেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, রূপালী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে নিজেদের মধ্যেই (এমনকি পরিচালকদের মাঝেও) ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার এসব ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ জামানত নেওয়ার কথা তা নেওয়া হয় নি। এরপর যে পরিমাণ জামানত নেওয়া হয়েছে, তার গুণগতমান খুবই দুর্বল। এসব ক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পদ হিসেবে যে পরিমাণ জমি দেখানো হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই সরকারি খাসজমি, ডোবা-নালা। এসব জালিয়াতি তো আছেই, বড় জালিয়াতি হচ্ছে এসব ঋণ বছরের পর বছর পরিশোধ করা হচ্ছে না। ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ পরিশোধ দেখানো হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। রূপালী ব্যাংকে বর্তমানে বিতর্কিত গ্রাহকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যার ফলে ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের।

অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির ব্যাপারে জানার জন্য সোমবার (২১ নভেম্বর) রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে ফোন দেওয়া হয়। এরপরও ফোন ধরেন নি তিনি। পাশাপাশি ফোনও ব্যাক করেন নি।

রূপালী ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগ : ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ৯টি দুর্বল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুতই সেগুলোকে সবল করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গভর্নরের এমন বক্তব্যের পর গত ২ অক্টোবর এসব পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণীর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ওয়ান ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অবস্থা এমনিতেই অনেক খারাপ। ব্যাংকটির পূর্ব নাম ছিলো ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙ্গে দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে এর নাম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়। অপরদিকে বর্তমানে বেশকিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক জাল-জালিয়াতি হয়েছে এবং হচ্ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া পর্যবেক্ষকেরা বোর্ড মিটিংয়ে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করতে পারবেন। 

এ ছাড়া ন্যাশনাল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা সশরীরে ব্যাংকে যাবেন না। কিন্তু ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখবেন।

এর আগে গত ৪ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করতে চার চলকের ওপর ভিত্তি করে এ দফায় ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা কোনও ব্যাংক বন্ধের পক্ষে না, আমানতকারীর টাকা যেনো নিরাপদ থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা চাই সব ব্যাংক ব্যবসা করবে, লাভ করবে এবং বাজারে টিকে থাকবে।’

খেলাপি ঋণ : পুরো ব্যাংক খাতে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

ব্যাংক খাতে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিলো ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিলো ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

এ সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের আগস্টে রূপালী ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দেন আতাউর রহমান প্রধান। তিন বছরের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকের এমডি হন। ২০১৬ সালের জুনে রূপালী ব্যাংকের ঋণ ছিলো ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আতাউর রহমানের মেয়াদকালে ২০১৯ সালের জুনে এ ঋণ বেড়ে হয় ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এ সময় খেলাপি বেড়ে হয় ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তাঁর তিন বছরের মেয়াদে গত জুনে ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয় ৩৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।

২০২১ সালে রূপালী ব্যাংক ঋণ থেকে সুদ আয় করেছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে আমানতের বিপরীতে সুদ গুনতে হয়েছে ২ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ট্রেজারি ব্যবসা থেকে গত বছর ব্যাংকটি আয় করেছে ১ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করে ৩৬ কোটি টাকা।

রূপালী ব্যাংকে বিতর্কিত গ্রাহক : এদিকে ভালো গ্রাহকের পাশাপাশি রূপালী ব্যাংকে বেশকিছু বিতর্কিত গ্রাহকও রয়েছেন। গত বছর শেষে ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক ছিলো মাদার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, যার ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ঋণ ৯০৭ কোটি টাকা। নুরজাহান গ্রুপের ৬২৯ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি। জুট টেক্সটাইল মিলসের ঋণ ৬২৪ কোটি টাকা, মাদারীপুর স্পিনিংয়ের ৬১৭ কোটি টাকা, বদর স্পিনিংয়ের ৪৬২ কোটি টাকা, ডলি কনস্ট্রাকশনের ৪৬৬ কোটি টাকা এবং ওরিয়ন গ্রুপের ২৮৩ কোটি টাকা। এসবের প্রায় সবাই বিতর্কিত এবং জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত।