এমপি আজীম হত্যা : পরিকল্পনা থেকে লাশের টুকরো ফেলা– সবক্ষেত্রেই শিলাস্তির নাম

এমপি আজীম হত্যা : পরিকল্পনা থেকে লাশের টুকরো ফেলা– সবক্ষেত্রেই শিলাস্তির নাম

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলেও এ বিষয়ে তাঁর তেমন কোনও ভূমিকা ছিলো না বলেই শুরুতে ধারণা করেছিলেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা ভেবেছিলেন, ঘটনাচক্রে হত্যার আগে বা পরে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শিলাস্তিও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তেমনটাই দাবি করেন। তবে হত্যারহস্যের পর্দা যতোই সরছে, ততোই তাঁর ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুই দেশের পুলিশ বলছে, তিনি খুনের পরিকল্পনায় ছিলেন, হত্যাকাণ্ডের সময়ও ফ্ল্যাটে ছিলেন। লাশের টুকরো ফ্ল্যাটের বাইরে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখেন।

এদিকে আজীমকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেপ্তার শিলাস্তিসহ তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি পুলিশ। অন্য দু’জন হলো– শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ ও ফয়সাল আলী। শুক্রবার (৩১ মে) আটদিনের রিমান্ড শেষে আসামিদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও আটদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। 

রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের দাবি জানায়। তবে আসামিপক্ষে কোনও আইনজীবী ছিলেন না। আসামিদের এজলাসে নেওয়ার পর কয়েকজন আইনজীবী তাদের পক্ষে মামলায় লড়তে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে চান। এ সময় পুলিশ সদস্যরা আইনজীবীদের বলেন, আদালতের সামনে আবেদন করে স্বাক্ষর নিতে হবে। শুনানির একপর্যায়ে বিচারক আসামি শিলাস্তিকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি আইনজীবী নিয়োগ করতে চান? জবাবে তিনি জানান– চান না। অপর দুই আসামিকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, মামলায় লড়তে আইনজীবী চান। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম শান্ত ইসলাম মল্লিক তাদের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে তিন আসামিকে আদালত থেকে ডিবির গাড়িতে তোলা হয়। 

এর আগে গত ২৪ মে এই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ২৩ মে তাদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২২ মে এমপি আজীমকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তাঁর মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

হত্যার সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন শিলাস্তি : ডিবি সূত্র জানায়, এমপি আজীমকে হত্যার সময় শিলাস্তি কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আজীমকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব ছিলো শিলাস্তির। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে আজীমকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।

শিলাস্তিসহ তিন আসামির রিমান্ড আবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করে ডিবি। আবেদনে বলা হয়, এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়াম ও মোস্তাফিজসহ অজ্ঞাতনামা অন্য আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানা সংগ্রহ ও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় নি। তাদের গ্রেপ্তার ও ঘটনার রহস্য জানতে গ্রেপ্তার তিন আসামির রিমান্ড প্রয়োজন।

আবেদনে আরও বলা হয়, গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) শীর্ষস্থানীয় নেতা। তিনি খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে আজীমের আদর্শের বিরোধ ছিলো। আর মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গেও আজীমের বিরোধ ছিলো। শাহীন ও শিমুল তাকে হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেন। গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দু’বার তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। পরে শাহীন কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় ২৫ এপ্রিল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরিকল্পনায় যুক্ত হন শিলাস্তি রহমান। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শাহীন গত ১০ এপ্রিল দেশে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে শিমুল ও শাহীনের নির্দেশে অন্য আসামিরা ভুক্তভোগীকে কৌশলে ব্যবসার কথা বলে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়া অন্য আসামির সহায়তায় আজীমকে হত্যা করেন। হত্যার পর হাড়-মাংস আলাদা করা হয়। মাংসের ছোট ছোট টুকরো করে ফ্ল্যাটের টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয়। এ ছাড়া হাড়সহ শরীরের অন্যান্য অংশ ট্রলিব্যাগে করে কলকাতার নিউ টাউন থেকে দূরে একটি খালে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যা ও হাড়-মাংস আলাদা করায় ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ সরাসরি জড়িত। 

হত্যা প্রমাণে সিআইডির হাতে ৬ সাক্ষী : কলকাতায় সিআইডির এফআইআরে মূলত সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে আরও অভিযুক্ত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না সিআইডি। সিআইডির এফআইআরে অভিযুক্ত হিসেবে রয়েছেন– সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল আলী শাহী, জিহাদ ওরফে জুবের, সিয়াম হোসেইন ও আক্তারুজ্জামান শাহীন। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

সিআইডি বলছে, সঞ্জীভা গার্ডেনের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের মূল ফ্লোরের বাথরুমে এমপি আজীমের দেহ টুকরো টুকরো করা হলেও রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিলো ঘরের চারদিকে। ফ্ল্যাটের মূল দরজার চার ফুটের মধ্যে পাওয়া যায় প্রথম নমুনা। দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় ছয় ফুট দূরে। অভিযুক্তদের প্রত্যেকের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। একাধিক সাক্ষীর বয়ান ইতোমধ্যে রেকর্ড করেছে তাঁরা। 

সিআইডির দাবি, কলকাতার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অন্তত তিনটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। সিআইডির এফআইআরে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গাড়িটি লাশ ফেলার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িটির চালক সিদ্ধার্থ কুণ্ডুকে অন্তত ৭০ ঘণ্টা পুলিশি জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তাঁকে এখনও গ্রেপ্তার করে নি পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় নি এমপি আজীমের কথিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকেও। এই দু’জনকেই সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সিআইডি। দু’জনের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে পুলিশি তদন্ত এগিয়েছে দ্রুতগতিতে। 

আর গোপাল বিশ্বাসের বরানগরের বাড়ি থেকে নিউ টাউনের অ্যাক্সিস মল পর্যন্ত যে হোন্ডা আমেজ গাড়িটি এমপি আনার ব্যবহার করেন, তাঁর চালক নাজিব খানকে একাধিকবার জেরা করলেও গ্রেপ্তার করে নি সিআইডি। 

সূত্র জানায়, তাঁকেও সাক্ষী হিসেবে চায় সিআইডি। সিআইডি বলছে, নাজিব জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন নিউমার্কেটের প্লাজা হোটেল থেকে এমপি আজীমকে বরানগরের বাড়ি থেকে নিউটন অ্যাক্সিস মল পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য তাঁর গাড়িটি বুক করেন মূলত ফয়সাল। এই প্লাজা হোটেলেই ২ মে থেকে অবস্থান নিয়েছিলো ফয়সাল এবং মোস্তাফিজুর। ফয়সাল নাজিবের পূর্বপরিচিত না হলেও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাঁকে চিহ্নিত করেন নাজিব। এ ছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গোপাল বিশ্বাসও ফয়সালকে চিহ্নিত করেছেন।

নাজিব জানান, ১৩ মে অ্যাক্সিস মলের পেছনের গেট থেকে  ফয়সাল এবং এমপি আনারকে তুলে নেন। ওই গাড়িতেই এসেছিলেন আমানুল্লাহ। তিনি গাড়িটি সঞ্জীভা গার্ডেন থেকে বুক করেছিলেন। 

সিআইডির দাবি, খুনের পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে সাজাতে আমানুল্লাহ কলকাতায় এসেছিলেন ৩০ এপ্রিল।

সিআইডির আরেক সাক্ষী বীরেন ভদ্র, যিনি মূলত বাড়িঘরের দালাল হিসেবে কাজ করেন নিউ টাউন এলাকায়। খুব কম সময়ে আক্তারুজ্জামান শাহীনকে সঞ্জীভা গার্ডেনের ডুপ্লেক্স বাংলোটি খুঁজে দেন বীরেন ভদ্র। তাঁকেও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার জেরা করেছে সিআইডি। বীরেন স্বীকার করেছেন, তিনিই আমানুল্লাহর জন্য সিদ্ধার্থর গাড়িটিও ভাড়া করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এমপি আজীম হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুনের দায় অস্বীকার করেন মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধার্থর বয়ান গুরুত্বপূর্ণ সিআইডির কাছে। সিআইডি জানতে পারে, খুন বা খুনের পরদিন শুধু নয়, বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সিদ্ধার্থর গাড়ি ব্যবহার করছিলেন অভিযুক্তরা। 
সিদ্ধার্থর বয়ান অনুযায়ী, জিহাদকে চিনার পার্কের ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে আক্তারুজ্জামান সোজা চলে যান বিমানবন্দরের কাছে ওটু রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন শিলাস্তি ও অন্যরা।

সিআইডির দাবি, ওই রেস্টুরেন্টেই ডিনার টেবিলে আনারকে খুনের চূড়ান্ত নকশা তৈরি করেন আক্তারুজ্জামান।

সঞ্জীভা গার্ডেনের কেয়ারটেকারের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৪ মে সকাল ১০টার দিকে ক্যাবে দুটি ভারী ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আবাসন ছাড়েন শিলাস্তি ও আমানুল্লাহ। ভারতীয় ইমিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, তারা ভারত ছাড়েন এর পরদিন। 

সিআইডি জানিয়েছে, এমপি আজীমের লাশের টুকরো ছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে একটি প্লাস্টিকের দড়ি, কালো টেপ, কিছু চুলের নমুনা পাওয়া গেছে। আর রিলায়েন্স জিওর একটি সিমকার্ড, শিলাস্তির নামে ইস্যু করা ৩০ এপ্রিলের ঢাকা থেকে কলকাতার নভো এয়ারের একটি বোর্ডিং পাস, মূল ফ্লোরের বাথরুমে থাকা কালো ও হলুদ রঙের তোয়ালে পাওয়া গেছে।