উপমহাদেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ

উপমহাদেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : ‘সে তারা ভরা রাতে, আমি পারি নি বোঝাতে, তোমাকে আমার মনের ব্যথা...’ আজও লাখো-কোটি শ্রোতার বুকে শীতল ঝড় তুলে যায় গানের এই সুরেলা শব্দ। অথচ এই সুরের স্রষ্টা আর নেই! এমন কালজয়ী বহু গানের স্রষ্টা, বাংলা সঙ্গীত জগতের এক মহান দিকপাল, রূপালী গিটার হাতে সুরের সম্রাট আইয়ুব বাচ্চু নেই আজ চার বছর। তবু রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি। আজও জীবন্ত, আজও প্রাণবন্ত! থাকবে অনন্তকাল।

উপমহাদেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট, সুরের জাদুকর, গীতিকার এবং সঙ্গীতশিল্পী এলআরবির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর)।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর বাবার নাম ইশহাক চৌধুরী, মা নুরজাহান বেগম। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন রক ব্যান্ডের গান শুনতেন। সেখান থেকেই ব্যান্ডের প্রতি ও গিটার বাজানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর বাবা তাঁকে ১১তম জন্মদিনে একটি গিটার উপহার দেন। সেই থেকেই গিটার বাজানোর প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। তাঁকে গিটার শেখাতেন জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ গিটার বাদক, যিনি তখন চট্টগ্রামে থাকতেন।

১৯৭৮ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে পথচলা শুরু করেন। এরপর ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন। নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু হয় ব্যান্ডদল ‘এলআরবি’র। 

আইয়ুব বাচ্চু মৃত্যুর আগে সুদীর্ঘ ২৫ বছর কাটিয়েছেন নিজ হাতে গড়া এলআরবির সঙ্গে। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল সোলস ছেড়ে এলআরবি গড়ে তুলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। শুরুতে ব্যান্ডটির নাম রাখা হয়েছিলো ‘লিটল রিভার ব্যান্ড (এলআরবি)। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে এই নাম বদল করে রাখা হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ (এলআরবি)। শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে সঙ্গীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুব বাচ্চু।

পিতা-মাতার আদরের সন্তান হলেও তাঁর সঙ্গীত চর্চায় ছিলো অনেক বাধা। সঙ্গীতপ্রেমী বাচ্চু পারিবারিক নিষেধ উপেক্ষা করেই নিজের স্বপ্ন জয় করেছেন। তবে জয়ের নেপথ্যে রয়েছে কঠিন-করুণ গল্প। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬ শ টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু অদম্য স্পৃহা, কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় তিনি অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর আইয়ুব বাচ্চু হয়ে ওঠেন। এক কথায় দীর্ঘদিন তিনিই ছিলেন দেশীয় ব্যান্ড সঙ্গীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা। কণ্ঠ-সুর আর গিটারের মন্ত্রণায় মাতোয়ারা করে রেখেছেন গানপ্রেমীদের। ভূষিত হয়েছিলেন গানের ‘বস’ খেতাবে।

আইয়ুব বাচ্চু মূলত রকস্টার। কিন্তু ব্যান্ড কিংবা রক তারকা হলেও অন্যান্য ঘরানার গানেও তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে আধুনিক এবং লোকগানে তিনি দক্ষতার প্রমাণ রেখে গেছেন। নিজের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অন্যান্য শিল্পীর জন্য আধুনিক, লোক এবং ক্লাসিক্যাল ঘরানার গানও তৈরি করেছেন। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর তাঁর গানের আদর্শ ছিলেন বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছেন। সুখের চেয়ে বেদনার চিত্রই গিটার জাদুকরের গানে বেশি ফুটে উঠেছে। যেনো গানের গল্পেই লুকানো তাঁর জীবন। জীবনের এপাশ-ওপাশ। হয়তো এ কারণে তাঁর হতাশার গানগুলো চোখ বুজেই লুফে নিয়েছেন শ্রোতারা।  

আইয়ুব বাচ্চুর অধিক জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘নীল বেদনা’, ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘সেই রূপালী গিটার ফেলে’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ফেরারী মন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কয়েক প্রজন্মকে গানের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই ক্যাসেট-ফিতার কাল পেরিয়ে স্মার্টফোন-ল্যাপটপের যুগে এসেও তাঁর গানের আবেদন কমে নি এতোটুকু। অটোগ্রাফের জমানা শেষে ফটোগ্রাফের আমলে, বাঙালির চিঠি লেখার অভ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার পর ই-মেইল, ফেসবুকের কালে প্রবেশের পরও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে নি একটুও।

দীর্ঘ কয়েক দশকে অসংখ্য কালজয়ী, জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। ‘চলো বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘মেয়ে’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সুখের এ পৃথিবী’, ‘ফেরারী মন’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘কবিতা’, ‘আমি তো প্রেমে পড়ি নি’, ‘তিন পুরুষ’, ‘যেও না চলে বন্ধু’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’ সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি।  

জানা গেছে, সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষিত হচ্ছে আইয়ুব বাচ্চুর গান। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি সঙ্গীত তারকা, যাঁর গান সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। ইতোমধ্যে ২৭২টি গান সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের উদ্যোগে আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে খোলা ওয়েবসাইটে। পরে তাঁর নামে কপিরাইট করা গানগুলোই এখানে ছাড়া হবে।

অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর না ফেরার দেশে চলে যান ব্যান্ড সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র আইয়ুব বাচ্চু।

সংসার জীবনে তিনি স্ত্রী, ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব নামে একজন কন্যা ও আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব নামে একজন পুত্রসন্তান রেখে গেছেন।