আমরা সংবাদকর্মীরা ও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন।

আমরা সংবাদকর্মীরা ও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন।
২০১৬ সালের ৬ মে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করতে যাওয়ার পর ফিরতিপথে লঞ্চের মধ্যে আমরা কয়েকজন সংবাদকর্মী।

কালাম আঝাদ’র কলাম : সময়টি শুরু ২০১৩ সালের প্রথম দিকেই। তখন পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। নানান জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর অবস্থানে অটুট। যে, পদ্মা সেতু হবেই হবে। এবং প্রয়োজনে তা হবে নিজস্ব অর্থায়নেই। তাঁর এ অটুট অবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে তখন দেশ-বিদেশের নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এবং বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মিত হলে সেখানে তাঁরা সহযোগিতা করবেন। এক্ষেত্রে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে একটি রূপরেখাও তুলে ধরলেন। পাশাপাশি কথা উঠে, পুঁজিবাজার থেকেও অর্থায়নের। সে সময় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সোনালী ব্যাংকে দুটি ব্যাংক হিসাবও খোলা হয়। এর একটি নিবাসী এবং অপরটি অনিবাসী। নিবাসী হিসাবটি রাখা হয়, দেশের মানুষের সহযোগিতার জন্য এবং অনিবাসী হিসাবটি খোলা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতার প্রয়োজনে।

ওই সময় অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে একটি ফোকাস সংখ্যা বের হয়। নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র ওই ফোকাস সংখ্যার সম্পাদনা আমি করি (মূলত সবগুলো লেখাও আমিই সংগ্রহ করি এবং লিড লেখাটি আমিই লিখেছিলাম। আর তা ছিলো ২ হাজার শব্দেরও বেশি শব্দে)। এবং ওই ফোকাস সংখ্যাটি বের হয় (প্রায়) পুরো ৩ নম্বর পৃষ্ঠাজুড়ে।

এদিকে ঘটনা পরিক্রমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং গভর্নরসহ অন্য সকল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানান, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নেই হবে, এক্ষেত্রে কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না। যেখানে প্রতি অর্থ বছরের বাজেট থেকেই কিছু কিছু করে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর অন্যদের পাশাপাশি অধিক সোচ্চার হয়ে উঠেন তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও।

আর তখন থেকেই আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রায় প্রতিটি একনেকের বৈঠক শেষেই সাংবাদিকদের পদ্মা সেতু সম্পর্কে পজেটিভ কথা তুলে ধরতে থাকেন।

একদিন একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করার ব্যাপারে। তখন আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, হ্যাঁ, আমরা সকল সাংবাদিকরা যেতে পারি পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিদর্শন করার জন্য। সেখানে গিয়ে সবকিছু দেখে নিউজ করলে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। এবং সেই নিউজগুলো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে।

তখন আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের আরও উচ্ছ্বসিত করার প্রয়োজনে বলেন, ‘যাঁরা যাঁরা (যে সকল সাংবাদিক) পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিদর্শনে যাবেন, তাঁদের সকলের নাম পদ্মা সেতুর নামফলকে লেখা থাকবে।’ 

এ কথাটি কারও কাছে কথার কথা কিংবা কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার পরও সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিলো, সেটি হলো : সাংবাদিকদের সকলেই পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যেতে চাইলেন। আর এলাকা পরিদর্শন করে সরেজমিন প্রতিবেদন করতে চাইলেন।

তো পরিকল্পনা অনুযায়ী, অবশেষে ২০১৬ সালের ৬ মে (শুক্রবার) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তথা তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের তত্ত্বাবধানে আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কয়েকটি বাসে করে গেলাম পদ্মা সেতু’র প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এলাকা থেকে বাসে করে যাওয়ার পর পদ্মা নদী পার হতে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় লঞ্চের।

সেতু সংশ্লিষ্ট এলাকা সম্পর্কে জানতে জানতে পদ্মা নদী পার হওয়ার পর ওপারে গিয়ে মাইক্রোবাসে করে অ্যাপ্রোচ রোড পরিদর্শন করি আমরা সবাই। এবং ফিরে আসি লঞ্চে (কেউ কেউ স্পিডবোটে করেও এসেছিলেন) করে। এর ফাঁকে আমরা জুমার নামাজ পড়ার খাওয়া-দাওয়া করি।

সেদিন গাড়িতে করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ফিরতে ফিরতে আমাদের রাত হয়ে যায়। মনে আছে, আমরা রাত ৯টার পরে পৌঁছাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। সে সময় (পদ্মা সেতুতে আমার যাওয়ার বিষয়টি অফিস জানে এবং আসার আগেও আমি আপডেট দিয়েছি) আমি অফিসে ফোন করে বলি, ‘আমি আসছি এবং আজকেই পদ্মা সেতু নিয়ে নিউজ দেবো।’ বলে রাখা ভালো এ ধরনের ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলো সাধারণত গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

মনে আছে, এরপর অফিসে গিয়ে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পদ্মা সেতু সম্পর্কিত একটি বিশেষসহ বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন দিই। যা ওইদিনই আমাদের সময় ডটকমে এবং পরদিন আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত হয়। 

এরপর পদ্মা সেতু সম্পর্কে সিরিজ বিশেষ প্রতিবেদন করি। যেখানে পদ্মা সেতু’র প্রকল্প পরিদর্শন করতে যাওয়ার পর আমাদের দেওয়া লিফলেট জাতীয় তথ্যবহুল কাগজগুলো বেশ কাজে লেগেছে।

এক্ষেত্রে বেশ কয়েকদিন (অন্তত সপ্তাহখানেক) আমরা যাঁরা পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, তাঁরা প্রতিযোগিতা দিয়ে প্রতিবেদন দিতে লাগলাম এবং আমাদের হাউসগুলো তা যথাযথ গুরুত্ব সহকারেই প্রকাশ করেছে।

এসব প্রতিবেদনের মধ্যে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু হওয়াসহ অন্যান্য অনেক খুটিনাটি বিষয় উঠে আসে। 

এক্ষেত্রে ওই সময় বাস্তবায়িত এবং বাস্তবায়নাধীন অ্যাপ্রোচ রোডের বেশকিছু ছবিও উঠে আসে প্রতিবেদনগুলোতে।

আমি মনে করি, আমরা যাঁরা পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, তাঁরা সকলেই হলফ করে বলতে পারি- পদ্মা সেতু নিয়ে সে সময়কার প্রতিবেদনগুলো প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে, এই অর্থে যে, তখন যাঁরা প্রকল্পে কাজ করছেন বা করবেন, তাঁদের যেমন শঙ্কা-ভীতি দূর হয়ে গিয়েছিলো; তেমনি সাধারণ মানুষের কাছে এমন বার্তা পৌঁছে গিয়েছিলো যে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন দুঃস্বপ্ন নয়; বরং তা বাস্তব।

সবমিলে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন এক সময় স্বপ্ন মনে হলেও প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বেশি দৃঢ়তা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অন্যদের সহযোগিতায় তা দৃশ্যমান হতে শুরু।

আর ওই দৃশ্যমান হওয়া এবং কত শতাংশ বাস্তবায়িত হলো, কতটি পিয়ার হলো, কিংবা কতটি স্ল্যাব বসলো; এর সকলক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের কাছে এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে দিনরাত কাজ করে যাওয়া কর্মীদের কাছে আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে এ দেশের গণমাধ্যম।

আজ পদ্মা সেতু বাস্তব। বাস্তব এ দেশের মানুষের স্বপ্ন। যা ২৫ জুন পুরোপুরিভাবেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে।

তাইতো বলতে হয়, জয়তু শেখ হাসিনা; জয় পদ্মা সেতু’র জয়।

জয় বাংলা।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, বাঙলা কাগজ ও আওয়ার ডন।

(উল্লেখ করা যেতে পারে, এই লেখাটি আগেও বাঙলা কাগজ ও ডনে প্রকাশিত হয়েছিলো, তবে আমাদের ডাটাবেজে সমস্যা হওয়ার কারণে কিছুটা সংশোধন ও সংযোজন করে, তা আবারও প্রকাশ করা হলো।)