সচিবালয়ের গেটে দুর্নীতি!

সচিবালয়ের গেটে দুর্নীতি!

শান্ত সিংহ : ঘড়ির কাটা তখন ঠিক ১২টা ৫০ মিনিট। সচিবালয়ে দুই নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ত্রিশোর্ধ এক ভদ্রলোক পাশে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই ভেতরে যাবেন?’ বাহ্, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। গেট পাশ ছাড়া আদৌ সচিবালয়ে প্রবেশ করা যায় কি না বা পাস ছাড়া কেউ সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারে কি না সেটা অবলোকন করাই আমার মিশন। কিন্তু সেটা এতো দ্রুত! কথা না বাড়িয়ে চলুন এবার মূল গল্পে যাই।

ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভেতরে যাওয়ার প্রক্রিয়া কী?’ পাল্টা প্রশ্ন ‘আগে কখনো গেছেন?’ না, সচিবালয়ে আজকেই প্রথম। সমস্যা নাই আমি পাস ব্যবস্থা করে দেবে। সেখান থেকে আমাকে দ্রুত সচিবালয়ের ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু আমার পুরো প্রক্রিয়া জানা দরকার। আবার জিজ্ঞাসা করি ‘ভেতরে যাওয়ার প্রক্রিয়া কী?’ বললে আমার জানা হলো আরকি। ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, আমার লোক আছে। আসেন আপনার প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিই। আবার আমাকে ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা। আমি বললাম, আমার সঙ্গে আরেকজন আছেন, উনি আসতেছেন। আমরা দুজনই যাবো। ‘আচ্ছা, সমস্যা নাই। উনি কত দূরে?’ আসতেছে। এখনই চলে আসবে। 

এখন আমার করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ভদ্রলোক জানান, জনপ্রতি তারা পাঁচশ টাকা নেন। 'আপনাদের দুজনের জন্য এক হাজার টাকা দিতে হবে। আসেন, আমার সাথে আসেন।’ আমি একটু সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে আরেকজন আছে যে..., এবার ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করি। সঙ্গে এটাও জানাই যে, আমাদের কাজের জন্যই হয়তো আরও আসা হতে পারে। এবার ভদ্রলোক নিজের নাম জানালেন। বললেন, নিজাম। ‘পরবর্তীতে আসলে জানাবেন, ব্যবস্থা করে দেবে।’ সঙ্গে সঙ্গে ফোন নম্বর দিয়ে দিলেন। মোবাইলে নম্বর তুলে যাচাই করে নিলাম নম্বর ঠিক আছে কি না। না, ভদ্রলোক তার সঠিক নম্বরই দিয়েছেন। কথা চূড়ান্ত হলো। এবার ভেতরে যাওয়ার পালা। দুজনে রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে গেলাম। ভেতরে ঢুকে আমাকে পাশে রেখে ভদ্রলোক (নিজাম) দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বললেন। কথা চূড়ান্ত হলো। এবার আমার টাকা দেওয়ার পালা। এ সময় আমার পরিচয়পত্র দেখালাম। পরিচয়পত্র দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক (নিজাম) বুঝতে সময় নেন নি। চট করেই সটকে পড়লেন। 

এই পুরো বিষয়টি যেখানে ঘটেছে, এর চারপাশে সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর সদস্যরা দায়িত্বরত। তাঁদের সামনেই ঘটেছে এসব।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে পাস ছাড়া ভেতরে প্রবেশের কোনও সুযোগ নেই বলে দাবি তাঁদের। টাকা দিয়ে পাস পাওয়ার সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেন তাঁরা।

নরসিংদী থেকে সচিবালয়ে এসেছেন শামীমা আক্তার। মেয়ে চট্টগ্রামে মেডিকেল হাসপাতালে চাকরি করেন, জামাই ঢাকায়। মেয়ের বদলির ব্যাপারে সচিবালয়ে এক মন্ত্রীর সুপারিশ নিতে এসেছেন তিনি। মন্ত্রী সম্পর্কে তাঁর আত্মীয়। ভেতরে প্রবেশের পাস নিয়েছেন। 

টাকা দিয়েও দালালের মাধ্যমে সচিবালয়ে প্রবেশের পাস পাওয়া যায়- বিষয়টি জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি ‘না’ সূচক জবাব দেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘সচিবালয়ের গেটেই দুর্নীতি, ভেতরের অবস্থা অজানা!’

টাকা দিয়ে সচিবালয়ের গেট পাস পাওয়ার বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. লিপিকা ভদ্র। পাস ব্যতীত সচিবালয়ে প্রবেশের কোনও সুযোগ নেই বলেই জানালেন তিনি।

তিনি বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই সচিবালয়ে প্রবেশের বেলায় আমরা আগের চেয়ে এখন আরও কড়াকড়ি করেছি। কেউ ওটিপি নিশ্চিত না করলে প্রবেশের সুযোগ পাবেন না। এটাকে আরও ডিজিটাইজ করার জন্য আমরা টেন্ডার দিয়েছি। এটাকে আমরা আরও আধুনিকায়ন করতে চাই। যদিও শর্ত অনুযায়ী এবার আমরা টেন্ডার পাই নি।

টাকা দিয়ে পাস পাওয়া গেলে সচিবালয়ে নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কি না জানতে চাইলে ড. লিপিকা ভদ্র বলেন, অবশ্যই নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কারা এসব করছে, কীভাবে এ সমস্ত ঘটনা ঘটছে, সে ব্যাপারে আমরা অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।