শাহজালাল সার কারখানা : কর্মকর্তার স্ত্রীর নামেই ৯১ গাড়ি
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০০৫ সালে বিসিআইসির প্রকল্প শাহজালাল সার কারখানায় সহকারী হিসাবরক্ষক পদে চাকরি নিয়েছিলেন। এরপর ১৪ বছরের চাকরিজীবনে তিনি সর্বশেষ ওই কারখানার সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন। এই সময়ে ৯১টি গাড়ি, ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, দুটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
এই ব্যক্তি হলেন খোন্দকার মুহম্মদ ইকবাল (৪২)। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার কারখানা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল ফার্টিলাইজারে চাকরি করতেন তিনি। অর্থ আত্মসাতের কারণে চার বছর আগে ওই কারখানা থেকে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ইকবাল তাঁর স্ত্রীর নামে দুটি নামসর্বস্ব কোম্পানি খোলেন। কোম্পানি দুটির নামে বেশ কিছু ভুয়া বিল ও রসিদ জমা দিয়ে ইকবাল শাহজালাল সার কারখানা প্রকল্প থেকে ৩৮ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মামলায় বলা হয়েছে।
সিআইডির দাবি, তারা গত বছরের জুলাই থেকে ১০ মাস অনুসন্ধান করে এই দম্পতির অপরাধলব্ধ আয়ের তথ্য পেয়েছে। এর ভিত্তিতে গত ২৬ এপ্রিল রাজধানীর মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান গত বৃহস্পতিবার বলেন, সিআইডির অনুসন্ধানে খোন্দকার ইকবাল ও তাঁর স্ত্রীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
■ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সিআইডির মামলা।
■ ১৬টি মামলা করেছে দুদক।
■ স্ত্রীসহ মুহম্মদ ইকবাল এখন কারাগারে।
সিআইডি ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুনে মুহম্মদ ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী হালিমা আক্তারকে (৪০) গ্রেপ্তার করে র্যাব। তখন তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে র্যাব। পরে র্যাবের অভিযোগের ভিত্তিতে ইকবাল ও হালিমা দম্পতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। অনুসন্ধান শেষে ২৬ এপ্রিল তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) সোহানুর রহমান। তিনি বলেন, খোন্দকার মুহম্মদ ইকবাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বিল ও রসিদ জমা দিয়ে বিসিআইসির শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পের ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৫১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব ভুয়া বিল ও রসিদ তৈরি করা হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান টিআই ইন্টারন্যাশনাল ও নুসরাত ট্রেডার্সের নামে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয় ইকবালের স্ত্রী হালিমা আক্তারের নামে।
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, খোন্দকার ইকবালের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। তিনি সর্বশেষ ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন। সিআইডি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন কোম্পানির নামে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছেন মূলত ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে।
বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আ ন ম শরীফুল আলম বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে খোন্দকার মুহম্মদ ইকবালকে চাকরিচ্যুত করে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। পরে দুদক মামলাও করে। ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী বর্তমানে কারাগারে।
জানা গেছে, এই দম্পতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ১৬টি মামলা করেছে দুদক। সিলেটে হওয়া মামলাগুলো তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। সিলেটের বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে কর্মরত দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) লুৎফুল কিবরিয়া বলেন, শাহজালাল ফার্টিলাইজার সার কারখানায় ভুয়া বিল জমা দিয়ে অর্থ আত্মসাতের মামলায় সিলেটের আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী কারাগারে রয়েছেন।
সিআইডির মামলায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইকবাল ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ৯১টি গাড়ির নিবন্ধন রয়েছে।
সিআইডির অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও মামলার বাদী এসআই সোহানুর রহমান বলেন, এই দম্পতির মালিকানায় থাকা মাইক্রোবাস, কার, পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন টিআই ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে রেন্ট-এ–কারের ব্যবসা করা হয়। এ ছাড়া তাঁদের ঢাকার শান্তিনগরে কয়েকটি ফ্ল্যাট ও ময়মনসিংহে জমি রয়েছে। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে ওয়ান পয়েন্ট ফার্মা অ্যান্ড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নামের তিনটি চেইন শপ রয়েছে।
সরেজমিনে সিদ্ধেশ্বরীতে ওয়ান পয়েন্ট ফার্মা অ্যান্ড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নামে দুটি দোকানের খোঁজ পেয়েছেন এই প্রতিনিধি। সেখানে শনিবার (৬ মে) দুপুরে কথা হয় স্টোরের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে। তিনি নিজের নাম বলেছেন সাব্বির হোসেন। তিনি বলেন, তিন বছর আগে খোন্দকার ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় তিনটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলে ব্যবসা শুরু করেন। একটি দোকান মাস চারেক আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
দুটি প্রতিষ্ঠান টিআই ইন্টারন্যাশনাল ও নুসরাত ট্রেডার্সের নামে ভুয়া বিল দিয়ে সার কারখানার টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে কোনো অফিস নেই বলে জানান সাব্বির হোসেন। আর তাঁর মালিকদের গাড়িগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া রয়েছে বলে জানান তিনি। গাড়ির মধ্যে রয়েছে কোস্টার, মাইক্রোবাস, কার ও পিকআপ। তবে গাড়ির সংখ্যা কতটি, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সাব্বির হোসেন।
সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে থেকে একজন ব্যক্তি পাঁচ বছরে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এত বিপুল অঙ্কের টাকা ভুয়া বিলের মাধ্যমে কীভাবে বের করে নিয়েছেন, সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে বিসিআইসি ও সার কারখানার আরও কেউ যুক্ত আছেন কি না, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত তদন্তে কিছু আসে নি।
এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিসিআইসির কর্মকর্তা খোন্দকার ইকবালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও অনেক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। কারও একার পক্ষে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া বিলের মাধ্যমে এত কোটি টাকা বের করে নেওয়া সম্ভব নয়।