রূপালী ব্যাংকে জালিয়াতির মহোৎসব

রূপালী ব্যাংকে জালিয়াতির মহোৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রনি রেজা : এ যেনো সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল। যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ। এমনই দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ তিন এমডির আমলে এমনই অবস্থা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের। যেখানে ঘটেছে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা। এসব ঘটনায় ইতোমধ্যে বেশকিছু মামলাও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমনকি শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। রূপালী ব্যাংকে অধিকাংশ জালিয়াতি হয়েছে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালের ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং, এলসি খোলায় জালিয়াতি, আইবিপি (অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়) এবং এলএটিআরের (বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ) মাধ্যমে। ব্যাংকটিতে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি এমনকি বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপার ক্ষেত্রেও অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি ব্যাংকটির কিছু অভিনব জালিয়াতিও দেখা গেছে। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে অর্থ লোপাট করেছেন; ফলে ক্ষতি হয়েছে ব্যাংকের; ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের।

অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির ব্যাপারে জানার জন্য রোববার (২০ নভেম্বর) রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হয়। তিনি ফোন না ধরলে পরে খুদেবার্তা পাঠিয়ে ফোন দেওয়া হয়। এরপরও নিরুত্তর থাকেন জাহাঙ্গীর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, রূপালী ব্যাংকে অস্তিত্ব ও যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ভুয়া বন্ধকি নিয়ে ঋণ ইস্যুর ঘটনা ঘটেছে। আর স্বল্প মেয়াদি ঋণ আদায় না করে তা দীর্ঘ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা হয়েছে।

তথ্যমতে, বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) এ বছরের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ধরা পড়েছে ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার। এরপরের বছর খাতটিতে আরও ৪ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি হয়েছে।

সিএজি রূপালী ব্যাংকের সর্বশেষ জালিয়াতি শনাক্ত করেছে ৯৩৪ কোটি টাকার। এ টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম বলেই জানিয়েছে সিএজি।

সিএজি রূপালী ব্যাংকের অনিয়মের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে মেয়াদি ঋণ আদায় না করে ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এলটিআর (লোন এগেইনেস্ট ট্রাস্ট রিসিপট বা বিশ্বাসী ঋণ) সৃষ্টি করা। এ কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। যেখানে গ্রাহক এই টাকা ফেরত দেয় নি। 

এ ছাড়া মঞ্জুরি শর্ত লঙ্ঘন করে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সীমারিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ শ কোটি টাকা। এটিও শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামানতবিহীন এলটিআর সৃষ্টি, ত্রুটিপূর্ণ রপ্তানি বিলের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া, শাখা ব্যবস্থাপনার যোগসাজশে এসএমই ঋণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া, ওই টাকা নিয়ে আংশিক চালুর পর রুগ্ণ হয়ে পড়েছে একটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি জালিয়াতি ও নিকাশের (ক্লিয়ারিং) মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, শর্ত অনুযায়ী ঋণ সমন্বয় না করায় খেলাপি হওয়াসহ আরও একাধিক ঘটনায় ব্যাংকের ১৪২ কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে রূপালী ব্যাংকে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রূপালী ব্যাংকের যে জালিয়াতি উদ্‌ঘাটিত হয়েছে, এর পরিমাণ আরও বেশ কয়েকগুণ।

সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংকে বেশ বড় বড় জালিয়াতির জন্ম দিয়ে ব্যাংকটি থেকে ২০১৬ সালে অবসরে যান তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দীন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মেয়াদ বৃদ্ধি করে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জালিয়াতের পর ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে যোগ দেন আতাউর রহমান প্রধান। যাঁর বিরুদ্ধে আগেই সোনালী ব্যাংকের যুক্তরাজ্য শাখায় সুইফট কোড জালিয়াতির অভিযোগ ছিলো। আর রূপালী ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর ব্যাংকের টাকা খরচ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট পদ নিয়েছেন। আতাউর রহমান প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন। 

এ ছাড়া তিনি রূপালী ব্যাংকে ব্যাপক জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঋণ প্রদান এবং ঋণ পুনঃতফশিলকরণে কমিশন আদায়সহ প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে আতাউর রহমান প্রধানের বিরুদ্ধে জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এরপর রূপালী ব্যাংকে এমডি হয়ে আসেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। আর মাসুদ রূপালী ব্যাংকে আসার পরও ব্যাংকটিতে যে জালিয়াতি হয়েছে, তা উঠে এসেছে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন প্রতিবেদনে।

জালিয়াতির কারণে ফরিদ উদ্দীনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন : ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম ফরিদ উদ্দীনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুদক। 

দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালের আগস্টে রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি, ডিএমডিসহ সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও তিন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

সংস্থার ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয় ১-এ মামলাটি করেন সহকারী পরিচালক এসএম রাশেদুর রেজা।

মামলার আসামিরা হলেন : রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এম ফরিদ উদ্দীন, সাবেক ডিএমডি কাজী মো. নেয়ামত উল্লাহ, রূপালী সদন করপোরেট শাখার সাবেক শাখা প্রধান মো. সিরাজ উদ্দিন, একই শাখার সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মো. কামাল উদ্দিন, ব্যাংকের শিল্পঋণ বিভাগের সাবেক ডিজিএম সৈয়দ আবুল মনসুর, একই বিভাগের এজিএম মনোরঞ্জন দাস, শিল্পঋণ বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার আবু নাছের মো. রিয়াজুল হক, এইচআর স্পিনিং মিলের এমডি মো. হাবিবুর রহমান, চেয়ারম্যান শাহিন রহমান ও পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান। 

তবে মামলার চার্জশিটে ব্যাংকের শিল্পঋণ বিভাগের এজিএম মনোরঞ্জন দাসের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও জালিয়াতির এবং অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে রেলওয়ের ১১৭ শতাংশ জমি দলিলের মাধ্যমে রূপালী ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকের মেয়াদি প্রকল্প ঋণের বিপরীতে বন্ধক রেখে মোট ১৬১ কোটি ৯১ লাখ ৬৫ হাজার ২৪৫ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন।

জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একক ব্যক্তি খাতে ব্যাংকের মোট মূলধনের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ফান্ডেড ঋণ (নগদ ঋণ) দেওয়া যায়। কিন্তু মেসার্স মাদার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামে গাজীপুরের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রায় ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে; যা মূলধনের প্রায় ৫৯ শতাংশ। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ব্যাংকের মূলধন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই ঋণ বিতরণে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী ঋণ ইস্যুকারী শাখা (স্থানীয় কার্যালয়) মোট ৫০২ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারে না। কিন্তু সেখানে ঋণ দেওয়া হয়েছে সীমার অনেক বেশি। এ ঘটনায় দায়-দায়িত্ব চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রূপালী ব্যাংকের তহবিল থেকে কর্মীদের কর পরিশোধ নিয়ে প্রশ্ন : নিয়ম বহির্ভূতভাবে রূপালী ব্যাংকের তহবিল থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর পরিশোধ করা হয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি তুলেছে অডিট অধিদপ্তর। এজন্য ব্যংকের তহবিল থেকে খরচ হয় দুই কোটি ৩২ লাখ টাকা। ওই টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাভারে রূপালী ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ : সাভারের আশুলিয়ায় রূপালী ব্যাংক শাখার এক ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে গ্রাহকের চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী হাজী ইছামুদ্দিন নামের ব্যাংকটির এক গ্রাহক। ইছামুদ্দিন মাদবর অভিযোগ করেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার রূপালী ব্যাংক সাভার ক্যান্টনমেন্ট শাখার একজন সঞ্চয়ী (হিসাব নং-৭৩৪২) হিসাব গ্রাহক। বাড়ি নির্মাণের জন্য পৈতৃক জমি বিক্রির ৪৪ লাখ টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন তিনি। 

সাড়ে ১৩ কোটি আত্মসাতে রূপালী ব্যাংকের ডিজিএমের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা : জাল জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের জমি নিজের নামে দেখিয়ে ব্যাংকে বন্ধক রেখে সাড়ে তেরো কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার শিল্প ঋণ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মাহমুদুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

দুদকের সহাকারী পরিচালক ফেরদৌস রহমান বাদি হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন : বি জি ব্ল্যাক টাইগার এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ খান গেদুর এবং রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের ময়মনসিংহের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (খুলনার করপোরেট শাখার সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা) কে বি এম সিরাজুদ্দৌলা।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা একে অপরের সহায়তায় অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বন্ধকীকৃত ২০ দশমিক ১৭৩ একর জমির মধ্যে ৩ দশমিক ৫৩২ একর অন্যের জমি নিজের মর্মে দাবি করে ব্যাংকে জামানত হিসাবে বন্ধকী প্রদান করে। জালিয়াতি করা বন্ধকীকৃত জমি অধিক মূল্য দেখিয়ে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের খুলনা শামস ভবন করপোরেট শাখা হতে ঋণ বাবদ ১৩ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৭৩৯ টাকা নেন। পরে সে টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেন।