ভাড়া বৃদ্ধি : বাড়তি খরচ পোষাতে ভাত কম খাবেন শাক বিক্রেতা আরজেনা

ভাড়া বৃদ্ধি : বাড়তি খরচ পোষাতে ভাত কম খাবেন শাক বিক্রেতা আরজেনা
ডন প্রতিবেদন : সেই ২৬ বছর আগে স্বামীরসঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু আজও কথায় কুষ্টিয়ার সেই টান রয়ে গেছে। সেই কথা স্মরণ করে দিতেই একগাল হেসে দেন আরজেনা বেগম। এই পঞ্চাশোর্ধ্বের আবাস রাজধানী লাগোয়া হেমায়েতপুর এলাকায়। তাঁর স্বামী তোতা মিয়া নিরাপত্তাপ্রহরীর কাজ করেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে। আরজেনা জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে মনিপুরীপাড়া লাগোয়া রাস্তার পাশে শাক বিক্রি করেন। রোজ সকালে রাস্তার পাশের ফুটপাতে বাজার বসে। শাকসবজি, ফল, মাছ, মোরগ, ডিম—সবই মেলে এখানে। তিন বছর ধরে সেখানেই শাক বিক্রি করছেন আরজেনা। আগে বসতেন চন্দ্রিমা উদ্যানে। বছর তিনেক হলো এখানে। হেমায়েতপুর থেকে মনিপুরীপাড়ায় রোজ আসা–যাওয়া করেন আরজেনা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে বাসের ভাড়া। আসা–যাওয়ার খরচও বেড়েছে। এসবের প্রভাব জীবনে যে পড়বেই, আরজেনা তা নিশ্চিত। কীভাবে সব সামলাবেন? এ প্রশ্নে আরজেনার উত্তর , ‘তাহলে তো ভাত কম খাতি হবে। আগে দ্যাড় কেজি কিনতাম, এখন এক কেজি কিনতি হবে। দৈনিক ১ হাজার ৫২০ টাকা বেশি লাগলি সেই টাকায় এট্টু মসলা কিনতি পারতাম। তা এখন পারবো নানি।’ ভোরের আলো না ফুটতেই হেমায়েতপুর বাজার থেকে শাক কেনেন। লাল, পালং, ডাঁটা, কলমি, ঢেঁকি- যখন যা পান কয়েক পদ নিয়ে আসেন। হেমায়েতপুর থেকে একটি তৈরি পোশাক কারখানার গাড়িতে রাজধানীর শ্যামলী পর্যন্ত আসেন। মালসামান থাকে, তাই সেই গাড়িতে ভাড়া দিতে হয় ৫০ টাকা। আজও তা–ই দিয়েছেন। তবে বাসচালকের সহকারী বলে দিয়েছেন, কাল থেকে ৬০ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিদিন ১০ টাকা বাড়তি। আর মাসে ছাক্কা ৩০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয়। রাজধানীর শ্যামলীতে নেমে রিকশা ধরেন। অতো সকালে ‘রিকশা-চলাচল নিষিদ্ধ’ বড় সড়কে রিকশা চলতে কেউ বাধা দেয় না। সেই রিকশার ভাড়া ৫০ টাকা। সেই ভাড়া বাড়ে নি, রিকশাওয়ালাও বলে দেয়নি, কাল বেশি দিতে হবে। তবে আরজেনার ভাবনা, ‘অন্য গাড়ির ভাড়া যখন বাইড়েছে, রিকশার ভাড়া বাড়তি আর কতক্ষণ!’ ভাবনা আরও আছে। মনিপুরীপাড়া–সংলগ্ন এলাকা থেকে জাতীয় সংসদের পথ ধরে মোহাম্মদপুর–সংলগ্ন গাবতলী সড়কে গিয়ে বাস ধরে রোজ বাড়ি ফেরেন। আগে ১৫ টাকা দিলে হেমায়েতপুর যাওয়া যেত। আরজেনা শুনেছেন, সেই ভাড়া রাতারাতি ২০ টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ সেখানে গুনতে হবে ১৫০ টাকা। ৩০০ আর এর সঙ্গে ১৫০ মিলিয়ে মাসে যাবে ৪৫০ টাকা। রোজ দেড় থেকে দুই হাজার টাকার পণ্য বা শাক নিয়ে আসেন। সব খরচ মিলিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা থাকে। মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার। এর মধ্যে থেকে ৪৫০ টাকা আরজেনার জন্য অনেক টাকা। কারণ, অক্ষরজ্ঞানহীন আরজেনার কথা, ‘এই ডিজিলের দাম বাড়ানির জন্যি বাসের ভাড়া বাইড়েছে। এখন অন্য সবকিছুর দাম বাড়বে। সব সময় এই হয়। আমাগের দেশে একবার কিছুর দাম বাইড়লে সবকিছু বাড়ে। আগেও দিকিছি। হুজুগ, হুজুগ।’ কোনোদিন স্কুলে না গেলেও তাঁর ভাষায় ‘পেটে-ভাতে’ চলা এই নারীর বাস্তবতা বোধ কিন্তু অর্থনীতির নিয়মের বাইরে নয়। অর্থনীতিবিদেরা জ্বালানিকে ‘কৌশলগত পণ্য’ হিসেবে গণ্য করেন। এর কারণ, সব পণ্য ও সেবার দামের ওপর প্রভাব পড়ে জ্বালানির দাম বাড়লে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে জ্বালানি তেলের ব্যবসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরকার প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখে, যাতে দেশের মানুষের ওপর চাপ না পড়ে। এই কৃচ্ছ্রসাধন তিনি আর অন্য কোথাও করতে পারবেন না। চার মাস আগে স্ট্রোক করেছিলেন। সেই জন্য ওষুধ খেতে হয়। তো খেতেই হবে। স্বামী আট হাজার টাকা পান। সেই টাকার অনেকটা যায় তাঁর খাওয়া-চলা আর ওষুধ কিনতে। আরজেনা-তোতা মিয়া দম্পতির তিন মেয়ে। তিনজনেরই বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটা সবচেয়ে বেশি, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। কুষ্টিয়ায় থাকে সেই মেয়ে। তার বিয়েতে দেড় লাখ টাকা কর্জ করতে হয়েছিল। সেই ধার এখন মেটাতে হয় প্রতি মাসে। সেখানেও তো পাওনাদারকে টাকা দিতে হবে। এসব সুখ-দুঃখের কথায় সময় পেরোয়। আজ সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। আলোচ্য বিষয় , জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধি, গতকালের ২৭ শতাংশ পরিবহন ব্যয় বাড়ানো—এসব। সরকারি নীতির বড় বড় বিষয় তাঁর ভাবনার বিষয় নয় বলেই জানান আরজেনা বেগম। তাই শুরুতে কথাই বলতে চাননি। পরে অনেক কথা হলো। কথাবার্তায় এক আহত, পরাজিত মানুষের সুর প্রবল। বললেন, ‘ভাড়া বাড়ালি তো দিতি হবে। দেবও। সরকার ভাড়া বাড়াইয়ে কামাইয়ের ধান্দা ধইরেছে। আমরা কী করব, আমার ভাড়া তো সরকার আসি দেবে না। আমাগে তো কিছু করার নেই।’ করোনার সময় সবকিছু যখন বন্ধ, তখন খুব কষ্ট করে বাজারে এসে শাক বিক্রি করেছেন। শুনেছেন, অনেক গরিব মানুষ টাকা পেয়েছে। কিন্তু ‘এক পয়সাও’ তাঁর ভাগ্যে জোটে নি। তাঁর স্বামীও পান নি। আরজেনার কথা, ‘নেতা-খ্যাতাগো সাতি পরিচয় না থাকলি কিছু পাওয়া যায় না। ম্যালা দিকিছি।’ বেশ কিছুক্ষণ কথার শেষে বিদায় চান আরজেনা। গ্রাম থেকে একদা রাজধানীতে ভাগ্য ফেরাতে আসা এই পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর সুখ-দুঃখের নানা কথায় নোটবুকের বেশ কয়েকটি পাতা তখন পূর্ণ। প্রতিবেদকেরও প্রয়োজন শেষ। আরজেনা বেগম বিদায় নেন আবার নতুন করে আগামীকালের শ্রমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। যানবাহনের বাড়তি ভাড়া সেই সঙ্গে হয়তো আরও নতুন নতুন দাম বাড়ার বোঝা মাথায় নিয়ে, মেনে নিয়ে চলতে একজন শেখা আরজেনা বেগম। কারণ, তিনিই একটু আগে বলেছিলেন, ‘আমাগে তো কিছু করার নেই।’