বিশ্ব বাবা দিবস : ট্রেনে কর্মরত বাবা-ছেলের সেলফি ঘুরছে নেট দুনিয়ায়।
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : ২০১৯ সালের ১৪ মে। ছেলে এস এম ওয়াসিবুর রহমান দ্রুতযান ট্রেন নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন। আর বাবা এস এম ওহিদুর রহমান সীমান্ত ট্রেন নিয়ে খুলনা থেকে নীলফামারীর চিলাহাটি যাচ্ছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশনে পৌঁছে দুই ট্রেনের ক্রসিং হয়। সীমান্ত তখন দাঁড়িয়ে।
এমনই এক মুহূর্তে দ্রুতযানের খাবার গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ওয়াসিবুর। আর তাঁর বাবা দাঁড়িয়ে সীমান্তের গার্ড ব্রেকে। চলন্ত ট্রেন থেকেই ছেলে তাঁর বাবার সঙ্গে একটি সেলফি তুললেন। তবে এই একটি সেলফির জন্য মুঠোফোনে কতগুলো যে ক্লিক করতে হয়েছিল তার হিসাব নেই।
সেলফি তোলার পর ওয়াসিবুর তা ফেসবুকে পোস্ট করেন। নেট দুনিয়ার মানুষ বাবা ও ছেলের সেলফিটি পছন্দ করেন। কেউ কেউ ট্রেনে চলন্ত অবস্থায় সেলফি তোলার জন্য সমালোচনাও করেন। তবে আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক, নেট দুনিয়ায় ২০১৯ সালের এ সেলফি এখনো আলোড়ন তোলে। রেলওয়ে গ্যালারি, রূপসী সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন গ্রুপ ছবিটি বিভিন্ন সময় শেয়ার করে, পরে তা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়।
ওয়াসিবুর রহমান মুঠোফোনে হাসতে হাসতে বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘সেলফিটি সেভাবে চিন্তাভাবনা করে তুলিনি। পোস্টও করেছিলাম নিজের ভালো লাগা থেকে। তবে ছবিটি ঘুরেফিরে আলোচনায় থাকেই। একই পেশায় থাকা বাবার সঙ্গে সেলফি তুলেছি, তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছেন, ভাইরাল হয়েছে, ভালো তো অবশ্যই লাগে। আর কিছু সমালোচনা তো থাকবেই।’
সম্প্রতি আবার আলোচনায় আসা এই সেলফির সূত্র ধরে কথা হয় ওয়াসিবুরের সঙ্গে। জানালেন, তিনি বর্তমানে পার্বতীপুরে জুনিয়র টিটিই (ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক) পদে কর্মরত। তাঁর বাবা ট্রেন পরিচালক/গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খুলনা সদর দপ্তরে। ১৯ জুন বাবা দিবস সামনে রেখেই মূলত বাবার সঙ্গে একই পেশায় থাকা ওয়াসিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ হয়। তবে ট্রেনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ফোনে কথা বলতে পারেন না। কাজ শেষ করে তাঁকে ঘুমাতে হয়। তাই ফোনের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা সারতে হয়।
ওয়াসিবুর ট্রেনের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১১ বছর আগে ২০১১ সালে। তাঁর বাবার চাকরির মেয়াদ আছে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। ওয়াসিবুর হাসতে হাসতে বললেন, ‘সেলফিতে বাবা–ছেলে হাসছি। তবে বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও বেশ খানিকটা দূরত্বও আছে। বাবাকে ভয়ও পাই। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে তো সেভাবে কাছে পাইনি। তাই ঘটা করে কখনো বাবা দিবস পালন করা হয় নি। ঘটা করে বাবাকে ভালোবাসি তা–ও বলা হয়নি।’
ওয়াসিবুরের দাদার বাড়ি খুলনা আর নানা ও শ্বশুরবাড়ি বাগেরহাট। ওয়াসিবুরের এক বোন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। মা গৃহিনী। ওয়াসিবুর দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ছোট ছেলের বয়স পাঁচ মাস।
ওয়াসিবুর জানালেন, তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তখন রেলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। তারপর পরীক্ষা দিয়ে রেলওয়েতে যোগ দেওয়ায় অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বললেন, ‘রেলওয়েতে কাজ করব, সে রকম চিন্তাভাবনা ছিল না। রেলে ৪০ শতাংশ পোষ্য কোটা বিদ্যমান। তবে এর আগে উচ্চতাসহ সবকিছু যাচাই–বাছাই করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেতে হয়। তাই বাবা আছেন বলে সহজেই চাকরি হয়ে গেছে, এটা ভাবার কারণ নেই। তবে কোটা সুবিধা তো অবশ্যই সহায়ক হয়।’
চাকরিজীবনে বাবা ও ছেলে একই ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন অভিজ্ঞতাও আছে ওয়াসিবুরের। বলেন, একই ট্রেনে থাকলেও কাজের ধরন অনুযায়ী বাবা ও ছেলের দেখা হতো না। বাবা থাকতেন ট্রেনের পেছনে। সেখানে যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
ট্রেনের চাকরিতে ঈদের সময় কাজের চাপ বেশি থাকে। তাই ঈদে ছুটির কথা চিন্তা করা যায় না। অন্য সময় সাপ্তাহিক ছুটি বলে কিছু নেই। রোস্টার ডিউটি থাকে। ট্রেনে যতক্ষণ থাকতে হয়, ততক্ষণ শুয়ে-বসে কাটানোর কোনো উপায় নেই। ঘুমের ঘাটতি তো আছেই। রাতে ডিউটি থাকলে পরের দিন কাজ শেষ করার পর বাড়ি ফিরে ঘুমাতে হয়, জানালেন ওয়াসিবুর।
একদিকে ট্রেনে জনবলস্বল্পতা, অন্যদিকে নতুন ট্রেন যুক্ত হওয়ায় কর্মরতদের কাজের চাপ বেশি থাকে। এ প্রসঙ্গে ওয়াসিবুর বলেন, ট্রেনে কাজ করে পরিবারের সদস্যদের তেমন সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। পরিবারের অভিজ্ঞতা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সব সময় ভালো সম্পর্ক রাখা কঠিন হয়ে যায়। ঈদ, অসুখ–বিসুখ, স্বজনের মৃত্যু এমনকি জানাজায় অংশ নেওয়ার সুযোগও সব সময় মেলে না।
জন্মের পর থেকেই দেখেছেন বাবা রেলওয়েতে কর্মরত। ওয়াসিবুর বললেন, রেল পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখন নিজেই রেলে চাকরি করেন। তাই চাকরিতে যত সমস্যাই থাকুক, রেলের প্রতি তাঁর দায় ও ভালোবাসাটা অপরিসীম, যা বাইরের কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না।