প্রধানমন্ত্রী : শেখ কামালের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে যুব সমাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করবে।

প্রধানমন্ত্রী : শেখ কামালের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে যুব সমাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করবে।

বাসস : প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, শেখ কামালের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের যুব সমাজ নিজেদেরকে গড়ে তুলবে এবং শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের মর্যাদাকে আরও সমুন্নত করবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল আমাদের জন্য যে নীতি, আদর্শ, কর্মপন্থা ও দিক নির্দেশনা রেখে গেছেন, তা থেকে আমাদের যুব সমাজ তাঁদের চলার পথে তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে, তা অনুসরণ করে নিজেদেরকে গড়ে তুলবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুক্রবার (৫ আগস্ট) সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন এবং শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার-২০২২ প্রদান অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন।

তিনি তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শুধু দেশে নয়, বিশ্ব তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যেনো আমাদের মেধা ও মননকে বিকশিত করে বাংলাদেশের মর্যাদাটাকে আরও উন্নত করতে পারি, সেভাবেই আমাদের ছেলে-মেয়েরা কাজ করবে, সেটাই আমি চাই।’

তিনি বলেন, আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই, আধুনিক ফুটবল খেলা এবং আবাহনী ক্রীড়া চক্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খেলাধুলায় ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে কামাল। পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চায় স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশীয় গানকে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে তুলে তাকে জনপ্রিয় করার কাজটিও সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছে। কেননা বহুমুখী প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন শেখ কামাল।

প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, বাসার ছাদে তাঁর সঙ্গীত দলের এই অনুশীলন চলতো যেখানে ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাসিরউদ্দিন সহ অনেকেই আসতো।

জাতির পিতা হত্যার ৬ বছর পর দেশে ফিরতে সক্ষম হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের জাতির পিতার বাড়িটিকে তিনি মিউজিয়াম করলে সেখানে ফিরোজ সাঁই কামালের অর্গান, যেটি দিয়ে তিনি গান তুলতেন, সেটি দিয়ে যায়। তাঁর সেই অর্গান এবং কামালের ‘সেতার’টি তিনি সেখানেই রেখে দিয়েছেন, জানান প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, শেখ কামাল সেনাবাহিনীতে কমিশন পেলেও যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর লেখাপড়া তখনো শেষ হয় নি, তাই মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণের জন্য সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তি হয়। কিন্তু মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশিত হবার আগেই না ফেরার দেশে চলে যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার প্রবর্তনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ কামালের অবদান সকলের মনে থাকবে।

তিনি আরও বলেন, সঙ্গে সঙ্গে এটা আমি চাই, আমাদের দেশের যুব সমাজ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সমাজসেবাসহ সবদিকে আরও উদ্যোগী হবে এবং নিজেদেরকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করবে, সেটাই আমার আকাঙ্ক্ষা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য তাঁর দল যখনই সরকারে এসেছে, তখনই দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের সেবায় শেখ কামাল যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর সরকার সিড মানি দিয়ে বিভিন্ন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছে।

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ এবং স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী হাবলু স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ কামালের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত ‘এক আলোর পথের যাত্রী’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী পরে শেখ কামালকে নিয়ে রচিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল আলোকিত তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি’ শীর্ষক সচিত্র স্মারক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী আজ।

১৯৪৯ সালের এইদিনে তিনি তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোরাতে বিপদগামী একদল সেনা কর্মকর্তার নির্মম বুলেটে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জাতির পিতা ও বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শাহাদাতবরণ করেন।

শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে কামালের জন্মদিন। কামাল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলো। একাধারে সে হকি খেলতো, ফুটবল খেলতো, ক্রিকেট খেলতো। আবার সেতার বাজাতো। ভালো গান গাইতে পারতো। নাটকে অংশগ্রহণ করতো। তাঁর অনেক নাটক করা আছে। উপস্থিত বক্তব্যে সে সব সময় পুরস্কার পেতো।

এতো প্রতিভার পাশপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল রাজনৈতিকভাবেও সচেতন ছিলেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, শাহীন স্কুল থেকে পাস করে যখন ঢাকা কলেজে পড়তো, তখন থেকে সে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আমরা সংগঠন করতাম, কখনো কোনও পদ নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিলো না।

তিনি বলেন, আমার বাবা শিখিয়েছেন, মানুষের জন্য রাজনীতি করা। তাঁর আদর্শ নিয়ে আমরা পথ চলতাম। তিনিই আমাদের শিখিয়েছিলেন, সাদাসিদে জীবনযাপন করতে হবে। কাজেই ‘সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং’। এটাই ছিলো আমাদের মটো। এটাই আমাদের শিখিয়েছিলেন এবং আমরা সেটাই করতাম।

তিনি বলেন, শেখ কামাল সব সময় অত্যন্ত সাদাসিদেভাবে চলাফেরা করতেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা খুবই সীমিত ছিলো। এমনকি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে তাঁর কোনও অহঙ্কার ছিলো না। শুধু একজন ক্রীড়াবিদ নয়, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর যেমন দূরদর্শিতা ছিলো, তেমনি লেখাপড়াতেও ছিলেন মেধাবী।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে’ সেই কথা মেনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুসংগঠিত হচ্ছিলো এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে কাজ করছিলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোড, আবাহনী ক্লাব এলাকা ও সাত মসজিদ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার যুব সমাজকে সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন। 

‘(১৯৭১ সালের) ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ওই রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য সে বাসা থেকে চলে যায়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা করলে, তৎকালিন ইপিআরের ওয়্যারলেস যোগে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরই জাতির পিতাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাঁর মাসহ পরিবারের সদস্যদের বন্দি করা হলে, কামাল লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় (পরে শেখ জামালও মুক্তিযুদ্ধে চলে যান)।

তিনি বলেন, কামালকে কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, লেখাপড়া করার জন্য তাঁকে সব রকমের সহযোগিতা করবেন। কামাল তাতে রাজি না হয়ে বরং বলেছে, আমি যুদ্ধ করতে এসেছি, যুদ্ধই করবো, ট্রেনিং নেবো। সে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি নিযুক্ত হয়। সে এবং মেজর নূর কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিলো।

প্রধানমন্ত্রী ও বড় বোন শেখ হাসিনা শেখ কামালের সঙ্গে ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কেননা পিঠেপিঠি ছোট ভাই কামাল যে তাঁর খেলার সাথীও ছিলো। ছোট্ট কামালকে নিয়ে কারাগারে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যাওয়ারও টুকরো স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কামালের জন্মের পরপরই আব্বা গ্রেপ্তার হয়ে যান এবং ’৪৯ সাল থেকে ’৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। কামালের ছোটবেলায় আমি যেমন আব্বাকে দেখে আব্বা আব্বা বলে ছুটে যেতাম, ও ঠিক তেমনটা যেতে পারতো না। আমাকে জিগ্যেস করতো, এইভাবে ওর ভেতর সবসময় একটা অতৃপ্তি ছিলো। তবে, আব্বা বের হবার (কারামুক্তি) পরপর তাঁকে যথেষ্ট আদর করতেন, কেননা ছোটবেলায় সে বাবার আদর বঞ্চিত হয়েছিলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কামাল এবং খুনি নূর একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিলো। নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে এই নূরই প্রথম আসে। কামাল মনে হয় ধোকায় পড়ে গিয়েছিলো তাকে দেখে। ভেবেছিলো, বোধহয় তারা উদ্ধার করতে এসেছে। কিন্তু তারা যে ঘাতক হয়েছে, সেটা জানতো না। কারণ প্রথম তারা কামালকে গুলি করে। তারপর একে একে পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে।