জালিয়াত চক্রে ঢুকে পড়েছেন রূপালীর এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

জালিয়াত চক্রে ঢুকে পড়েছেন রূপালীর এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ; রাহাতুল রাফি : ব্যাংক খাতে জালিয়াত চক্রের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এরমধ্যে বড় গ্রুপগুলোকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জালিয়াত চক্রের সংখ্যাই বেশি। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার কিছু অসাধু লোকও কাজ করেন। বিনিময়ে তাঁরা বড় গ্রুপগুলোর কাছ থেকে অর্থ নেন। প্রায় দেড় বছর আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরও সেই জালিয়াত চক্রে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রয়েছে- পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রদানে সহযোগিতা, বার্ষিক ও আর্থিক প্রতিবেদনে ভুল তথ্য প্রদান, ঋণ প্রদানে সাম্প্রতিক সময়ে বড় পার্সেন্টেজের কমিশন গ্রহণ, আগ্রাসীভাবে সিংহভাগ ঋণ বড় গ্রুপগুলোর হাতে তুলে দেওয়া এবং আইবিপি (অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়) ও করপোরেট গ্যারান্টিতে বড় ধরনের অনিয়মে সহযোগিতা। সবমিলিয়ে বড় জালিয়াতির কারণে রূপালী ব্যাংক বর্তমানে খেলাপি ঋণে ধুঁকছে।

অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জানার জন্য বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয় নি।

জানা গেছে, রূপালী ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রাসীভাবে সিংহভাগ ঋণ তুলে দিচ্ছে বড় গ্রুপগুলোর হাতে। এসব অনেক ঋণ সময়মতো আদায় হচ্ছে না। ব্যাংকটির ঋণ দিয়ে যে সুদ আয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে আমানতকারীদের। এর ফলে মূল সুদ ব্যবসায় ব্যাংকটি লোকসান করছে। ঋণের বাইরে অন্য বিনিয়োগ ও সেবা থেকে আয় করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও খরচ মেটাতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাড়সুবিধা নিয়ে ২০২২ সালে ২১ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে ব্যাংকটি। তবে শেয়ারধারীদের কোনও লভ্যাংশ দিতে পারে নি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় খাতের এ ব্যাংক। বিষয়টি রূপালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের অদক্ষতা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের ব্যাংক আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় ২০০৫ সালে রূপালী ব্যাংককে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরের বছর ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রির জন্য বিভিন্ন দেশে রোড শো করে বেসরকারিকরণ কমিশন। ওই সময়ে একজন সৌদি বিনিয়োগকারী ব্যাংকটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি এগোয় নি। এখন একদিকে বড় কয়েকজন গ্রাহক ও অন্যদিকে বড় খেলাপি— এসব নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি। যে ফাঁদে পড়েছে, তাতেই আটকা পড়েছে। বের হতে পারছে না। ব্যবসা বাড়াতে নতুন করে কার্যকর কোনও পরিকল্পনাও করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুনে রূপালী ব্যাংকের আমানত ছিলো ৪৭ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা, গত জুনে যা বেড়ে হয়েছে ৬৬ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে ঋণ ৩১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। তিন বছরে আমানত ১৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিলো ৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, রূপালী ব্যাংক খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য বিনিয়োগের বিপরীতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাড়তি সময় নিচ্ছে। ২০২২ সালের বার্ষিক হিসাব চূড়ান্তের জন্য ব্যাংকটিকে ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকটি মুনাফা থেকে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়। বাকি ৬ হাজার ৮৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার জন্য ব্যাংকটিকে চলতি বছর পর্যন্ত সময় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে ব্যাংকটি ২১ কোটি টাকা মুনাফা করার সুযোগ পেয়েছে।

সূত্র বলছে, চলতি বছরের বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করার সময়ও বাংলাদেশ ব্যাংকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছেন না রূপালী ব্যাংক। একইসঙ্গে গত বছরের ন্যায় এ বছরও বার্ষিক হিসাবে গোজামিল দেওয়া হয়েছে। তবে এবারের আর্থিক বিবরণী প্রকাশিত হওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে রূপালী ব্যাংক ফাঁসতে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর বিষয়টির দায় কোনোভাবেই প্রধান নির্বাহী হিসেবে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এড়াতে পারেন না। কারণ রূপালী ব্যাংকের গত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনেও গোজামিল ধরা পড়েছে।

সূত্র আরও বলছে, এমডি ও সিইও হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর রূপালী ব্যাংকে পদোন্নতিতে বেশ অনিয়ম করেছেন রূপালীর এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তবে বর্তমানে তাঁর ব্যাপারে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বড় গ্রুপগুলোকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ প্রদান।