আ.লীগ নেত্রীর ৮৯ কোটি টাকা ঋণ : বিড়ম্বনায় ব্যাংক

আ.লীগ নেত্রীর ৮৯ কোটি টাকা ঋণ : বিড়ম্বনায় ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেত্রী জাকিয়া সুলতানা বেবীর প্রায় ৮৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ৩৯ বছর আগে নেওয়া ওই ঋণ আদায়ে এ পর্যন্ত তিনবার শতভাগ সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয়। তবে তিনি এক টাকাও শোধ করেন নি।

সর্বশেষ ৬ বছরে ৭২ কিস্তিতে ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা পরিশোধ করে দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো তাঁকে। তিনি এ সুযোগ গ্রহণ না করে উল্টো ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন মামলার ফাঁদে ফেলছেন। ঋণ আদায় মামলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করায় আদালত তাঁকে ৬ মাসের দেওয়ানি কারাদণ্ডাদেশ দিলেও  অজ্ঞাত কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করছে না।

জাকিয়া পটুয়াখালী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে, ঋণের টাকা ফেরত না দিতে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করছেন। একই কারণে পুলিশও তাঁকে গ্রেপ্তার করছে না।

জানা গেছে, পটুয়াখালী শহরের বিসিকে স্থাপিত একটি টেক্সটাইল মিলের নামে ১৯৮৫ সালে ২ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন জাকিয়ার স্বামী সিরাজুল ইসলাম (বর্তমানে মৃত)। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ৭৫ ভাগ এবং জাকিয়া বাকি অংশের মালিক।

সিরাজুলের মৃত্যুর পর শতভাগ মালিকানা আসে জাকিয়ার নামে। স্থাপনের পর মাত্র দুইমাস মিলটি চালু ছিলো বলে জানান জাকিয়া। 

সোনালী ব্যাংক পটুয়াখালী শাখা সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ঋণের এক টাকাও পরিশোধ করা হয় নি। সুদাসলে বর্তমানে আদায়যোগ্য ৮৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ১৯৯৩ সালে সিরাজুলকে ঋণখেলাপি ঘোষণার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০০৪ সালে পটুয়াখালী অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলা চলমান অবস্থায় মারা যান তিনি। এখন মূল বিবাদি জাকিয়া।

জানা গেছে, আসল টাকা আদায়ের জন্য ১৯৯৪ সালের ৯ এপ্রিল, ২০১১ সালের ২৭ জুলাই এবং ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি শতভাগ সুদ মওকুফ অনুমোদন দিয়েছিলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

সোনালী ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখার ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, সর্বশেষ মওকুফ সুবিধায় ৩ কোটি ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধযোগ্য ধার্য করে ৬ বছরে ৭২টি কিস্তির সুবিধা দেওয়া হয় তাঁকে। শর্ত ছিলো পরপর তিনটি কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে মওকুফ সুবিধা বাতিল হবে। আগের দু’বারও একই শর্ত দেওয়া হয়েছিলো।

জিল্লুর জানান, অর্থঋণ আদালত ব্যাংকের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির জন্য মিলের মালিকানা ব্যাংকের অনুকূলে পেতে মামলা চলছে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও পুলিশ জাকিয়াকে গ্রেপ্তার করছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঋণ নেওয়ার পর পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা ও ছলচাতুরী শুরু করেন সিরাজুল-জাকিয়া দম্পতি। ঋণের বিপরীতে বন্ধকি দেওয়া বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় ২৮ শতাংশ জমি জালিয়াতি করে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বন্ধকি দেওয়া পটুয়াখালী শহরের সিঅ্যান্ডবি সড়কের বসতবাড়ির নিলাম ঠেকাতে জাকিয়ার প্রবাসী ভাই মাহবুবুর রহমানকে দিয়ে আদালতে ডিক্রি মামলা দায়ের করা হয় ২০১৬ সালে। ফলে বন্ধকি সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

পটুয়াখালী জেলা বিসিকের শিল্পনগরীর কর্মকর্তা আল আমিন জানান, বহু বছর বন্ধ থাকায় টেক্সটাইল মিলটি এখন আর চালুর উপযোগী নেই। সার্ভিস চার্জ বাবদ মিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিসিকের পাওনা ১৭ লক্ষাধিক টাকা। বিসিক কর্তৃপক্ষ প্লট বরাদ্দ বাতিল করে মিলটি উচ্ছেদ করতে চাইলেও ব্যাংকের সঙ্গে মামলা থাকায় কিছু করতে পারছে না। জাকিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে পটুয়াখালী সদর থানার ওসি জসিম জানান, পুলিশ একাধিকবার বাসায় গিয়ে তাঁকে পায় নি। তাঁকে এখন এলাকাতে দেখা যাচ্ছে না।

জাকিয়া বলেন, এরশাদ সরকার আমলে দেওয়া বিশেষ প্রকল্পের আওতায় তাঁর স্বামী টেক্সটাইল মিলটি করেছিলেন। প্রকল্পের ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা পরে না দেওয়ায় এবং এরশাদ সরকারের পতনে মিলটি চালু করতে পারেন নি। মিলের যন্ত্রাংশ বিক্রি করে ব্যাংক ঋণের কিছু পরিশোধ করেছেন। এখন ব্যাংকের মূল পাওনা ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বলে দাবি জাকিয়ার। 

তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সুদ মওকুফের পরও বিভিন্ন খাতের চার্জ দেখিয়ে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেছে। তিনি মূল পাওনা ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পরিশোধের দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। এজন্য মওকুফ-পরবর্তী কিস্তি দেন নি।  

জাকিয়ার দাবি করেন, সিঅ্যান্ডবি সড়কের বসতবাড়ি তাঁর ভাইয়ের টাকায় কেনা। ওই বাড়ি ব্যাংকে বন্ধকি দেওয়া হয় নি। আদালত থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন। তবে পুরো বিষয়টি পটুয়াখালীতে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন জাকিয়া। তিনি বলেন, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য ব্যাংক ঋণের বিষয়টি সামনে এনে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চলছে।