ঘৃণিত হোলি আর্টিজান হামলার ৬ বছর : জঙ্গিরা কোণঠাসা, অনলাইনে সক্রিয়।

ঘৃণিত হোলি আর্টিজান হামলার ৬ বছর : জঙ্গিরা কোণঠাসা, অনলাইনে সক্রিয়।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ৬ বছর আজ (পহেলা জুলাই)। সেদিনও পহেলা জুলাই ছিলো শুক্রবার। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এক দিন।

কী ঘটেছিলো সেদিন : সন্ধ্যারাতে হঠাৎ করে খবর আসে গুলশানে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেলো, এক রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলাকারী ঢুকে বেশ কয়েকজনকে জিম্মিও করেছে।

কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী? গুজব নাকি সত্য- সেটি নিশ্চিত হতেও চলে গেলো ঘণ্টাখানেক সময়।

পরে জানা গেলো, হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে (হোলি আর্টিজান বেকারি) থাকা বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে।

এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে জানা যায়, গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে।

জিম্মি সঙ্কটের ঘটনায় পহেলা জুলাই সন্ধ্যারাত থেকে দিবাগত সারারাত অর্থাৎ ২রা জুলাই সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের নজর ছিলো ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারির দিকে।

রাত ৯টা ৫ মিনিট : গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলার খবর পায় পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় পুলিশের বড় টিম। 

রাত ৯টা ২০ মিনিট : ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক এ সময় টুইট করেন ‘পুলিশ ইজ সারাউন্ডিং দ্য এরিয়া, গানফায়ার স্টিল অন’।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।

রাত ১০টার দিকে পুলিশ, র‍্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরাও ৭৯ নম্বর রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন।

রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে মারা যান বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন।

রাত চারটা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

আইএসের দায় স্বীকার : রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’ এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হবার কথা জানায়।

আইএসের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে ৫ জনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করা হয়। হামলার দায় স্বীকার করে নেয় তারা।

২রা জুলাই অভিযানের ঘটনাক্রম : সকাল ৭টা ৩০ মিনিট : রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।

৭টা ৪৫ মিনিট : কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।

সকাল সোয়া ৮টা : রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশি নাগরিক তাঁর মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন।

৮টা ৫৫ মিনিট : ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তাঁরা।

৯টা ১৫ মিনিট : অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সঙ্কটের অবসান হয়।

সকাল ১০টা : ৪ জন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত ৫ জনের মৃতদেহ পাবার কথা পুলিশ জানায়।

১১টা ৫০ মিনিট : অভিযানে জঙ্গিদের ৬ জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।

দুপুর ১টা ৩০ মিনিট : আইএসপিআর থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার কতো : হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার পরপরই দেশজুড়ে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স ও অপারেশন টোয়াইলাইট থেকে শুরু করে বেশকিছু কঠোর অভিযানে ৮০ জন জঙ্গি নিহত এবং ৪ শরও বেশি গ্রেপ্তার হয়। এর পরপর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এ গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১ হাজার ৬ শ ছাড়িয়ে যায়। সেটি হয় স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার পরে জঙ্গি দমনের অভিযানগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে শুধু র‌্যাবের হাতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ১ হাজার ৬৭৮ জন। পাশাপাশি জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের দুটি ইউনিট গ্রেপ্তার করেছে ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ৫৫৯ এবং অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গ্রেপ্তার করেছে ১৭৩ জন।

জানা গেছে, সিটিটিসির অভিযানে হোলি আর্টিজান হামলার পর গত ৬ বছরে গ্রেপ্তার ৫৫৯ জনের মধ্যে নব্য জেএমবির সদস্যই ২০৪ জন। আর নব্য জেএমবির সদস্যরাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিলো। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। ফলে এখন জঙ্গিরা সর্বোপরি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, গত ২ বছরে দেশে কোনও জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে নি। আমরা জঙ্গি দমন করার মাধ্যমে দেশে শান্তি বজায় রাখতে পেরেছি।

তিনি বলেন, জঙ্গি দমনে এখন শুধু অভিযান নয়, কেউ যেনো জঙ্গিবাদে না জড়ায়, সেজন্য সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, এখন জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে। তারা এখন অনলাইনে বেশি সক্রিয়। সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আর দীর্ঘদিন ধরে পলাতক অনেক জঙ্গিকে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তিনি জানান, জঙ্গি দমনের বিষয়টি শুধু অভিযানে সীমাবদ্ধ নেই, উগ্রবাদ মুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় অনেককেই জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

জঙ্গিবাদ দমনের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, জঙ্গি নির্মূলে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। আমরা কাউকেই এ ব্যাপারে কোনও ধরনের ছাড় দেবো না।

জানা গেছে, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর এ পর্যন্ত জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ১ হাজার ৬৭৮ জনের মধ্যে জেএমবির সদস্য ৮৬৪ জন। 

এ ছাড়া আল্লাহর দলের ২০১ জন, আনসার আল ইসলামের ৫৯২ জন এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

বাহিনীটি আরও জানায়, গত ৬ বছরে র‌্যাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ৭৭৯টি অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান ছিলো ৫৪টি। বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে ১৬ হাজার ৫ শ কেজি।

অনলাইনে সক্রিয় জঙ্গিরা : দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জোর তৎপরতার মুখে এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বর্তমানে জঙ্গিরা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। তাদের প্রায় সকল নেতাই বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ার পর এখন তারা এক রকম ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। আবার র‌্যাবের কঠোর নজরদারির কারণে নিজেদের মধ্যে ফোনেও যোগাযোগ রাখতে পারছে না তারা। তবে জঙ্গিরা এখন বিভিন্ন নামে-বেনামে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। আর এসব ব্যাপারেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা এখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় পৌঁছেছে।