কবি জীবনানন্দ দাশ : বকুল ও কৃষ্ণচূড়া ফুল তাঁর পছন্দের

কবি জীবনানন্দ দাশ : বকুল ও কৃষ্ণচূড়া ফুল তাঁর পছন্দের

হাসান হাফিজ : নিসর্গ, নির্জনতা, ঐতিহ্যের কবি জীবনানন্দ দাশ। জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি। মৃত্যু ২২ অক্টোবর ১৯৫৪। কেমন স্বভাব ছিলো তাঁর? ব্যক্তিমানুষ হিসেবে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোই বা কেমন ছিলো? এই রচনায় তাঁর সুহৃদ, স্বজন বন্ধু, নিত্যসহচরদের স্মৃতিচারণ থেকে আমরা তুলে আনবো এক একটি সুগন্ধি পুষ্প। তা দিয়ে চেষ্টা করবো মালা গ্রন্থনের। যে বইটি এই রচনার উৎস, তার নাম ‘জীবননান্দ: জীবন আর সৃষ্টি’। সম্পাদনা করেছেন সুব্রত রুদ্র। ১০০৮ পৃষ্ঠার বৃহদায়তন এ গ্রন্থটি বের করেছে কলকাতার নাথ পাবলিশিং। প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৯৯।

কবি জীবনানন্দ দাশ বকুল আর কৃষ্ণচূড়া ফুল খুবই পছন্দ করতেন। বরিশালে যে ঘরটিতে বসে লিখতেন, তার সামনেই ছিল সতেজ, সুস্পষ্ট ঘন পল্লবিত একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। কলকাতায় পথ চলতে গিয়ে যে সব গাছপালা চোখে পড়তো, তা পছন্দ হতো না কবির। বলতেন ‘এসব বিশ্রী গাছ। রুচি, রসবোধ কিছু নেই এদের। আমার হাতে যদি এতটুকু ক্ষমতা থাকতো, দু’ধারে শুধু লাগিয়ে দিতাম বকুল আর কৃষ্ণচূড়া।’

এক সময় কবির মাথার চুল উঠে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে কেশবিরল হয়ে আসছিল মাথার পেছনে দিকটা। মাথায় টাক পড়ুক-এটা কিছুতেই চাইতেন না তিনি। অতএব টাক হঠানোর যুদ্ধে নামলেন। ভাইটেক্স, বল্ড এল, মহাভৃঙ্গরাজ- টাকপ্রতিরোধী সব অস্ত্রই ছোঁড়া হলো। কিন্তু হায়! কোনো ফল পাওয়া গেলো না। একদিন হাঁটতে হাঁটতে নিত্য সহচর সুবোধ রায়কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার টাকটা বোঝা যায়? দেখুন তো পিছন থেকে’।

এ প্রশ্ন আগেও বারবার করেছেন। সঙ্গী ‘না’ বললে খুশি, ‘হ্যাঁ’ বললে উদ্বিগ্ন হতেন। সঙ্গী উত্তর দিলেন,

‘তা একটু বোঝা যায় বৈকি। সূর্য বন্দনা করেন তো অনেক কবিতাতে। এখন ঠ্যালা সামলান।’

‘তার মানে?’

‘মানে স্পষ্ট। টেকো চাঁদি ফাটিয়ে ছাড়বে আপনার জ্বলন্ত সূর্য, দুপুরে যখন রাস্তায় বেরুবেন।’

‘তা হোক। সে সব কিছু না। কথা হচ্ছে, দেখতে বড়ো বিশ্রী লাগে। সূর্যকে ভয় নেই। ভয় রাত্রিকে। কিছুদিন পর লাইটপোস্টের তলা দিয়ে তো আর হাঁটাই যাবে না। চাঁদনি রাতে দেখেছেন কোনোদিন পদ্মার ইলিশকে ডিগবাজি খেতে?’

বলেই হেসে ওঠেন কবি। সর্বাঙ্গ দোলানো উচ্ছ্বসিত হাসি।

কবি পত্নী লাবণ্য দাশ তাঁর স্বামী সম্পর্কে লিখেছেন ‘মানুষ জীবনানন্দ’ শিরোনামে। লাবণ্য দাশ লিখেছেন :

‘লোকে জানে, কবি ছিলেন শান্ত নিরীহ প্রকৃতির। অর্থাৎ এক কথায় যাকে বলে ভালমানুষ। তাঁকে চালানো খুবই সোজা। কিন্তু ছাইছাপা আগুনের মত সেই নিরীহভাবের নীচেই চাপা থাকত তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তবে অকারণ চিৎকারে সে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ করাটা তিনি কোনদিনই পছন্দ করতেন না। শান্তভাবে, অল্প কথার ভিতরই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি। তাঁর এ পরিচয় আমি বহুবার বহুভাবে পেয়েছি।’

তিনি মিলের মোটা ধুতি ছাড়া পরতেন না, এবং একটু উঁচু করেই পরতেন। আমি একদিন একখানা ভাল ধুতি কিনে কবিকে বললাম - ‘ কী যে তুমি মোটা মোটা ধুতি হাঁটুর উপরে পরে রাস্তা দিয়ে হাঁট। লোকে হাসে না?’ কথাটা বলেই ধুতিখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।

তিনি তখন কি একটা লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ধুতিখানা ধরেও দেখলেন না। তার মুখে সামান্য একটু বিরক্তির ভাবও প্রকাশ পেল না। শুধু লেখাটা থামিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখ, তুমি যেভাবে খুশি সাজপোশাক কর, তোমার সে ইচ্ছেয় আমি কোনদিনই বাধা দেব না। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে তোমার ইচ্ছামত চালাতে বৃথা চেষ্টা কোরো না।

তিনি রাগলেনও না, বকাবকিও করলেন না। কিন্তু আমার মনে হল কে যেন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি টেনে নিয়েছে। আমি কোনওমতে নিজেকে টানতে টানতে সেখান থেকে সরে এলাম।

যতদিন তিনি পৃথিবীতে ছিলেন, আমার মুখ থেকে এ রকম কথা আর কোনদিনই বের হয়নি। যেদিন তিনি চিরদিনের মতই যাত্রা করলেন, সেই ধুতিখানাই পরিয়ে দিলাম। সেখানা বছরের পর বছর আমার বাক্সেই রাখা ছিলো।

তবে আমার সে অন্যায় কাজে তিনি যে মোটেই রাগ করেননি, তার প্রমাণ পেয়েছি স্বপ্নের ভিতর দিয়ে। এক রাতে স্বপ্ন দেখলাম, তিনি স্নানের ঘরে ঢুকে তার ধুতির খানিকটা জায়গা ধুচ্ছেন। আমিও ঠিক সেই সময় কি কারণে সেদিকে গিয়ে তাঁকে দেখে অবাক হয়েই তাঁর দিকে তাকিয়েছি। আমাকে দেখে সলজ্জমুখে তিনি বললেন, ‘দেখ তো, কি মুস্কিল! আমার মাত্র একখানাই ধুতি। তাও আবার কাদায় ভরে গেল। তাকিয়ে দেখি তাঁকে শেষ সময়ে পরানো আমার সেই ধুতিখানাই তিনি সযত্নে ধুচ্ছেন।

ঘুমটা আমার ভেঙে গেল। স্বপ্নের কোন অর্থ আছে কিনা জানি না। তবে মনে হয়, আমি যে অন্য কাউকে না দিয়ে চার পাঁচ বছর ধরে তাঁর ধুতি রেখে দিয়েছি শুধু ভেবেই তাঁর আত্মা কষ্ট পেয়েছে। তাই স্বপ্নের ভিতর দিয়েই তিনি আমার এতকালের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিয়েছেন।

সংসারের কাজ নিজের হাতে করতে আমি চিরদিনই ভালবাসি। কিন্তু সেই অবস্থায় বন্ধুদের সামনে বের হলে কবি খুবই বিরক্ত হতেন। তিনি মনে করতেন যে তাতে তাঁদের সঠিক অভ্যর্থনা বা আদর আপ্যায়ন করা হয় না।

ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে একদিন সকালের দিকে বালতি করে জল নিয়ে আমি বারান্দা ধুচ্ছি, ঠিক সেই সময় সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। আমার শাড়ি বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে- ডান হাতে ঝাঁটা। চাকরটি অন্য কাজে আটকা থাকাতে আমি সেই অবস্থাতেই দরজা খুলে দিতে গেলাম।

দরজা খুলেই কিন্তু আমাকে আড়ালে সরে যেতে হল। কারণ ভিতরে ঢুকলেন কবিবন্ধু অচিন্ত্যকুমার ও বুদ্ধদেব বাবু। ততক্ষণে কবিও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি যে খুবই বিরক্ত হয়েছেন সেটা তাঁর মুখে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। অথচ বন্ধুদের সামনে আমাকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। চাকরকে ঝাঁটা বালতি সরিয়ে নিতে বলে আমি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

তাঁরা চলে যাবার পরে কবি খুব দুঃখের সঙ্গে আমাকে বললেন, ‘তুমি যে কি কর। বন্ধুবান্ধব মহলে আমার মানসম্ভ্রম আর থাকল না। অচিন্ত্য ও বুদ্ধদেব বাবু আজ তোমাকে ঠিক কি ভেবে গেলেন।’

‘তা কি করব বল। আমি তো জানতাম না যে, তোমার বন্ধুরা আসবেন। জানলে কি আর ঝাঁটা হাতে তাদের সামনে যাই। কিন্তু আমাকে কি ভাবলে তো তোমারই ডিসকোয়ালিফিকেশন’ আমি উত্তর দিলাম।

তিনি কথাটার অর্থ ধরতে না পেরে অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখন আমি হাসতে হাসতেই বললাম, ‘তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। বুদ্ধদেববাবু তো আমাকে বিয়ের সময়ই দেখেছেন, সুতরাং আমি যে বেশেই থাকি না কেন, তিনি আমাকে চিনবেন বলে মনে হয়। আর অচিন্ত্যবাবুর বাড়ির মেয়েরাও সংসারের কাজ করে থাকেন। তাছাড়া তাকে তো রসিক বলেই জানি। কবি জায়ার বদলে আমাকে ঝি ভাবলে ঠিকই তোমাকে জিজ্ঞাসা করতেন: এইরকম ঝি কোথায় পেলে?’

সেদিন তিনি এমন জব্দ হয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে এ প্রশ্ন আর কোনদিনই তোলেন নি।

প্রখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। কবি তখন বাড়ি ছিলেন না। তিনি আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে আবার একদিন আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন।

কবি বাড়িতে আসা মাত্রই আমি তাঁকে প্রেমেনবাবুর কথা জানালাম। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সভয়ে বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, আমি বাড়ি থাকতেই ঝাঁটা হাতে আমার বন্ধুদের সামনে যেতে তোমার বাধে না, আর আমার অনুপস্থিতিতে প্রেমেন বাবু এসেছিলেন, তার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। হয়তো বঁটি হাতেই হাজির হয়েছিলে।’

এত অতর্কিতে কবির পৃথিবীর মায়া কাটাবার নোটিস জারি হবে- সে কথা প্রেমেনবাবু কল্পনাও করতে পারেননি। প্রতিশ্রুতি রাখতে হয়তো তিনি এসেছিলেন, কিন্তু কবিকে ফুলের সাজে খাটে শোয়া অবস্থায় দেখে হয়তো নীরবেই ফিরে গিয়েছিলেন।”

এবার আমরা একটু জানতে চাইব কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশের স্মৃতিচারণাটি কেমন? মঞ্জুশ্রী দাশের লেখাটির নাম ‘জীবনানন্দ দাশ: আমার বাবা’। তিনি লিখেছেন :

‘... আমাদের বাড়িতে অনেকে আসতেন। জ্ঞানী গুণী মানী। লেখক কবি অধ্যাপক। সাধারণ অসাধারণ। বাবা কথা বলতেন, আপ্যায়ন করতেন আন্তরিকভাবে। তিনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। সৌজন্যবোধ ছিল অপরিসীম। কিন্তু কাউকে স্তবস্তুতি করেননি। বাবার মর্যাদাবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর।’

তরুণেরা আসতেন, আমন্ত্রণ জানাতেন সভা সমিতির জন্য। কিন্তু বাবা এ বিষয়ে অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন।

বাবা ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনা সভায় উপস্থিত থাকতেন। দেখেছি-সাধারণত সভা শুরু হলে প্রবেশ করতেন এবং শেষ হবার খানিকটা আগেই বেরিয়ে পড়তেন। ধর্ম বিষয়ে কোন হৈ চৈ তিনি কখনই পছন্দ করতেন না। আত্মনিবেদনই বোধহয় প্রাধান্য পেত তাঁর কাছে।

বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তার তরুণ দিনগুলি গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিল না। পরে মধ্যাহ্ন সূর্য যখন আকাশে জ্বলছে সেই রূঢ় রোদে পথ চলেছেন। অনেক কারণে অনেক যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়েছে।

আমাদের বরিশালের বাড়িতে প্রত্যুষে প্রথম আভায় দাদু উপনিষদ পাঠ করতেন। ঠাকুমা উপাসনার গান গাইতেন। আমার দাদু ঠাকুমার ছিল পুণ্যের জীবন।

কোনও সময়ে বাবা বলেছিলেন, আমরা যখন তরুণ ইংরেজ সরকারে ভাল কাজ পাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু যখন অ্যধাপক হলাম তখন দেশের মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমি তো সেই ইংরেজের দাস হতে পারি না।

একদিন এক বিশেষ পরিচিত মানুষ বাবাকে অনুরোধ জানালেন, আদালতে কোন বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে। বাবা এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। একদিন এক ভদ্রলোক বাবার একটি ভাল বই নিলেন। কিন্তু দিলেন না। বাবা নীরব রইলেন। এ সময়ে কাকামণি একটি বই পড়তে নিয়েছিলেন। আবার কদিন পরে বইটি রেখে গেলেন, যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই। আমাদের বললেন, অশোকের দায়িত্বজ্ঞান খুব।”

লেখার শেষাংশে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে সাতটি উদ্ধৃতি :-

০১.

একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে

ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে

সে আসবে মনে হয়; আমার দুয়ার অন্ধকারে

কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!

০২.

আমার এ- গান

কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে,-

আজ রাত্রে আমার আহ্বান

ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-

তবুও হৃদয়ে গান আসে!

০৩.

চিলের ডানার থেকে ঠিকরিয়ে রোদ

চুমোর মতন চুপে মানুষের চোখে এসে পড়ে;

শত টুকরোর মতো ভেঙে সূর্য ক্রমে আরও স্থির-

স্থিরতর হতে চায় নদীর ভিতরে।

০৪.

কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;

তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:

০৫.

সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে

সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তারে ফেলেছে সে মুছে অবহেলা!

০৬.

তোমার মাথার চুলে কেবলি রাত্রির মতো চুল

তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল

রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে

ধ’রে আছে।

০৭.

মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম

তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো

বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।