‘ওরে ডাক্তার বানাইতে কতো কষ্ট করছি, ও হইলো জঙ্গি’

‘ওরে ডাক্তার বানাইতে কতো কষ্ট করছি, ও হইলো জঙ্গি’

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ‘ওরে ডাক্তার বানাইতে কত কষ্ট করছি, ও হইল জঙ্গি!  আমি কৃষিকাজ করে পরিবার নিয়ে কোনো রকমে চলি। ছেলের মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর পুরো গাঁয়ের মানুষ গর্ব করে বলত– গোবরে যেন পদ্ম ফুটেছে। ও আমার সম্মানহানি করছে।’ রোববার (১৩ আগস্ট) সকালে এভাবেই বলছিলেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘অপারেশন হিলসাইড’ অভিযানের সময় পালানো জঙ্গি ডা. সোহেল তানজিম রানার বাবা হেলাল উদ্দিন। সিরাজগঞ্জ সদরের সয়দাবাদ ইউনিয়নের পোড়াবাড়ী গ্রামে গেলে হেলাল আরও বলেন, ‘আমার ছেলে ও ছেলের বউ যদি অপরাধী হয়ে থাকে, দেশের প্রচলিত আইনে অবশ্যই তাদের বিচার হোক। পড়াশোনার সুবাদে প্রায় সাত বছর থেকে ছেলে বাড়ির বাইরে। নিজের পছন্দে বিয়ে করায় তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছিলো।’

কুলাউড়ার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে স্ত্রীসহ অন্যরা ধরা পড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক তানজিম রানা। দু’বছর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেছিলো। উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তুরাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।

আট মাস আগে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজে চাকরিতে যোগ দেন তানজিম। হাসপাতালের পাশেই একটি বাসায় স্বামী-স্ত্রী বাস করতেন।

‘জঙ্গিবাদ থেকে ফেরত এসো বাবা’ :
জঙ্গি অভিযানে আটক আরেকজন নটরডেম কলেজের ছাত্র ফাহিম। ছেলে আটক হওয়ার খবর শুনে যশোর থেকে রোববারই ঢাকায় ছুটে আসেন তার আইনজীবী বাবা আইয়ুব খান বাবুল। ওই অভিযানের বিষয়ে রোববার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট রাজধানীর মিন্টো রোডে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ১৭ বছরের ওই তরুণের বাবাও। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে ছেলের উদ্দেশে রেখেছেন আবেগঘন বক্তব্য। ছেলেকে স্বাভাবিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আইয়ুব খান বাবুল বলেন, ‘বাবা, তুমি যদি অসৎ ব্যক্তি বা সংগঠনের মাধ্যমে ভুল পথে গিয়ে থাকো, তুমি ফিরে এসো। তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। পড়াশোনা নিয়ে পরিবার থেকে আর চাপ দেওয়া হবে না। পরিবারের সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

বাবুল বলেন, ‘হঠাৎ ছেলের মধ্যে পরিবর্তন দেখেছি। ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার পর হঠাৎ ছেলের মুখে দাড়ি দেখি। তবে সে সময় নিয়মিত নামাজ পড়তো না। এর আগে রোজায় বাসায় গিয়ে হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেরিয়েছে সে। ২৮ জুলাই বাড়ি ছাড়ার আগে কলেজের বন্ধুদের নিয়ে এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছিলো। হঠাৎ একাই চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় কোনও টাকাপয়সা নিয়ে যায় নি। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ফাহিম গাইনোকমাসিয়া রোগে আক্রান্ত। তার একটি নাক সব সময় বন্ধ থাকে।’

সিটিটিসির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিরাজগঞ্জ থেকে সস্ত্রীক নিখোঁজ চিকিৎসক সোহেল তানজিম রানার সঙ্গে নটরডেম কলেজের ওই ছাত্র কুলাউড়ার ওই আস্তানা থেকে অভিযান শুরুর কিছু সময় আগে পালিয়ে যায়। সেই অভিযানে যে ছয় নারী ও চার পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসক রানার স্ত্রী মাইশা ইসলাম হাফসা। যাদের  আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের সেই কিশোরের ছবি দেখিয়ে তার অবস্থান নিশ্চিত করা গেছে বলে সিটিটিসি জানিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ইমাম মাহমুদ মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন। লোকজনকে বলতেন, জিহাদের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হলো গৃহত্যাগ তথা হিজরত। তাই জিহাদের প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দশ্যে ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার জন্য তারা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছিলেন।

সিটিটিসির ভাষ্য, সম্প্রতি যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়ে অনুসন্ধানে নামে সিটিটিসি। তাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থেকে চিকিৎসক সোহেল তানজীম রানা, যশোর থেকে ঢাকার নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুর থেকে এরশাদুজ্জামান শাহিনসহ আরও অনেকের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। 

গ্রেপ্তার তিনজন সাতক্ষীরার :
কুলাউড়া থেকে আটক শরিফুল ইসলাম (৪৮), স্ত্রী আমেনা বেগম (৪৪) ও মেয়ে হাবিবা খাতুনের (২০) বাড়ি  সাতক্ষীরার তালায়। শরিফুল পেশায় সাইকেল মিস্ত্রি। অভাবের সংসার তার। বেশ আগে থেকেই জাকের পার্টি করতেন। প্রতি বছরই জাকের মঞ্জিলে ওরশ শরিফে অংশ নিতেন শরিফুল। তবে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি এলাকার কেউ জানতো না। শরিফুলের বাড়িতে তালা ঝুলছে, কেউ নেই।  শফিকুল তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে গত ২৫ জুলাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর সবার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিলো। 

শরিফুলের বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। শরিফুল আগে কখনও খারাপ কাজের সঙ্গে জড়ায় নি।’

মাইশার ঘটনায় এলাকাবাসী বিস্মিত :
জঙ্গি আস্তানা থেকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মাইশা ইসলাম হাফসার বাবার বাড়ি নাটোরের চাঁদপুর গ্রামে আলোচনার ঝড় বইছে। তবে চিকিৎসক তানজিম রানার সঙ্গে দু’মাস আগে হাফসার বিয়ে হওয়ার খবর অনেকেই জানেন। এই পরিবারের দুই সদস্য মাইশার বাবা সাইদুর রহমান দুলাল ও চাচা ফজলুর রহমান জঙ্গি মামলায় আটক হয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনই জেল খেটেছেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে চাচা ফজলুর রহমান নিখোঁজ রয়েছেন। বছর দশেক আগে মাইশাদের বাড়িতে র‍্যাব হানা দিয়ে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় মাইশার বাবা লুৎফর রহমান দুলাল ও সৎচাচা ফজলুর রহমানও গ্রেপ্তার হন। মাইশার মামাতো ভাই মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই খবরে বিস্মিত হয়েছি। মাইশা আমাদের সামনেই বড় হয়েছে। সে খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কীভাবে কী হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না।’

কুলাউড়ায় আতঙ্ক কাটছে না :
কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের যোগীটিলা ও বাইশাটিলা। ওই এলাকার সাধারণ মানুষের এখনও ঘোর কাটছে না। কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ বলেন, ‘জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। এর মধ্যে গত শনিবার রাত থেকে বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে একেক সময় একেক সংস্থার নাম ব্যবহার করে মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করছে।’ জঙ্গিরাই এমন করছে বলে সন্দেহ তাঁদের।