এস আলমের সুদ মওকুফ করে বড় ঝুঁকিতে ন্যাশনাল ব্যাংক

এস আলমের সুদ মওকুফ করে বড় ঝুঁকিতে ন্যাশনাল ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : লোকসানে পড়েছে বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। বড় কয়েকজন গ্রাহক ঋণখেলাপি হয়ে পড়ায় ও অন্যদের ঋণের কিস্তি আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটির এই দশা হয়েছে। এর চেয়ে খারাপ তথ্য হলো, ব্যাংকটি আগে যেসব সুদ আয় খাতে নিয়ে মুনাফা করেছে, এস আলম গ্রুপের এমন ২ হাজার ৩ শ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। এসব মুনাফা থেকে সরকারকে করও দিয়েছে ব্যাংকটি। চলতি বছর শেষের আর্থিক হিসাবে যা আরও খারাপ পরিস্থিতি বয়ে আনবে। পাশাপাশি এর দায় মেটাতে হবে আরও কয়েক বছর।

এর মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংক নিজের আর্থিক স্বাস্থ্যকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মকানুন না মেনে মালিকপক্ষের সুপারিশে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণই এখন ব্যাংকটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঋণ অনুমোদন, সুদ মওকুফসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সহায়তা করেছে। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কিছুই করার ছিলো না।

জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংকের আয় অনেক কমে গেছে, লোকসান হয়েছে। সুদ মওকুফের পুরো বিষয়টি আমি জানি না। এতো সুদ মওকুফ হলে অনেক দিন এই চাপ বয়ে বেড়াতে হবে। এক বছরে এসব সমন্বয়ও করা যাবে না। বাড়তি সময় দিতে হবে।’

আর্থিক চিত্র :
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংক নিট লোকসান করেছে ৩৫৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ১৩৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিলো ব্যাংকটি। আর ২০২০ সালে নিট মুনাফা করেছিলো ৩৪৮ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ঋণ দিয়ে সুদ আয় করেছে ১ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। আর বিনিয়োগ করে আয় করে ৪০৮ কোটি টাকা। কমিশন, ব্রোকারেজসহ অন্য আয় ১৮৯ কোটি টাকা।

বেড়েছে খেলাপি :
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি।

ন্যাশনাল ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মাইশা গ্রুপের চার প্রতিষ্ঠানের কাছে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ২ শ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে, যা খেলাপি হয়ে পড়েছে। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট ও মাইশা রিয়েল এস্টেট, সিএলসি পাওয়ার ও ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি ও ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানিতে। মাইশা গ্রুপের কর্ণধার ছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হক। এমন আরও কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে ঋণের কিস্তিও শোধ করছেন না।

সামনে আরও বিপদ :
ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ ও গুলশান শাখার ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ব্যাংকটি। এসব সুদের বড় অংশ ব্যাংকটি গত ১০ বছরে আয়ে নিয়ে মুনাফা করেছে। আবার মুনাফা থেকে সরকারকে পরিচালক করও পরিশোধ করেছে। ফলে এসব সুদ এখন ব্যাংকটির আয় থেকে সমন্বয় করতে হবে।

ব্যাংকটির যে আর্থিক পরিস্থিতি তাতে এক বছরে কোনোভাবেই এত সুদ সমন্বয় করা সম্ভব না।

জানা গেছে, সুদ মওকুফ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের। পাশাপাশি গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : পুষ্টি ভেজিটেবল, ফেয়ারি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাফ ট্রেডিং ও আদিল করপোরেশন।

এদিকে ব্যাংকটি তারল্য-সঙ্কটেও পড়েছে। অনেক শাখায় আমানত কমেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) জমা রাখতে পারছে না। এজন্য প্রতিনিয়ত জরিমানা গুনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। এরপরও ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।