আহমেদীয়া ফাইন্যান্স : লাখে ছিলো ২০ হাজার টাকা মুনাফার ফাঁদ!

আহমেদীয়া ফাইন্যান্স : লাখে ছিলো ২০ হাজার টাকা মুনাফার ফাঁদ!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে মূলধন ঠিকই থাকে। মাসে ২০ শতাংশ হারে ২০ হাজার টাকা মুনাফা মেলে। ইউরো স্টার গ্রুপের আহমেদীয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির এমন চটকদার ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন হাজারো গ্রাহক। ১৭ বছরের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন আহমেদীয়া ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনির আহমেদ। প্রতারণার বিষয় বুঝতে পেরে গ্রাহকরা সোচ্চার হলে গা ঢাকা দেন মনির। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ডিবির খিলগাঁও সার্কেল থেকে মনিরকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ডিবি)।

ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে আহমেদীয়া ফাইন্যান্সের প্রধান কার্যালয়ের দখল নিয়ে অবস্থান করছেন। টাকা ফেরত পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। গতকাল শনিবার মনিরকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের ডেকে এনে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মনিরের বিরুদ্ধে মামলা করতে বললেও তাঁরা করেননি। গ্রাহকরা জানান, স্থানীয় ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মতিউর রহমান মোল্লা বিষয়টি মধ্যস্থতা করছেন। তিনি উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে গ্রাহকের পাওনা আদায় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালে আহমেদীয়া ফাইন্যান্স কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে চটকদার সব অফার দিয়ে গত ১৭ বছরে প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের এমডি মনির আহমেদ। গ্রাহকের টাকায় নিজে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বাড়িয়েছেন রিয়েল এস্টেটসহ নানা ধরনের ব্যবসা।

গতকাল রাজধানীর বনানীর ডিওএইচএসের করপোরেট অফিসে গেলে নিরাপত্তাকর্মী উজ্জল ইসলাম সিদ্দিকী জানান, 'মনির স্যার কখন আসবেন তিনি জানেন না। আদৌ আসবেন কি না বলা সম্ভব হচ্ছে না।'

পরে ডিবি কার্যালয়ের সামনে গেলে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানান, ডিবির কর্মকর্তারা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মনির আহমেদের বিরুদ্ধে মামলার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আপাতত কাউন্সিলর মতিউর রহমান বিষয়টি মীমাংসার দায়িত্ব নেওয়ায় মামলা করছেন না বলে জানান তাঁরা। তবে আগের মতোই প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করবেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইব্রাহিমপুরে আহমেদীয়া ফাইন্যান্সের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে কয়েকশ গ্রাহককে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাঁরা বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত অফিসে থাকবেন। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, অতি লাভের অফার দেখে পোশাককর্মী, রিকশাচালক, দিনমজুর, সবজি বিক্রেতা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্য, শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বিনিয়োগ করেছেন। আহমেদীয়া ফাইন্যান্স গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে এক লাখ টাকার বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে মাসে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারই সুযোগ নিয়েছেন এমডি মনির।

ইউরো স্টার গ্রুপের অন্যান্য ব্যবসার মধ্যে রয়েছে- আহমেদীয়া অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড, ইউরো স্টার ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, ইউরো স্টার মডেল টাউন, ইউরো স্টার হোম অ্যাপলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউরো স্টার ফিলিং স্টেশন ইত্যাদি।

আহমেদীয়া ফাইন্যান্সের ভুক্তভোগী গ্রাহক ফোরামের সভাপতি সুলতানা রাজিয়া বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, চড়া মুনাফার লোভ দেখিয়ে অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন এমডি মনির। আমি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এখন পথে বসে গেছি। টাকা ফেরত না পেলে কার্যালয় ছাড়ব না। শতবর্ষী আরেক গ্রাহক মোহাম্মদ আলী ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। পায়ে ধরেও কোনো টাকা ফেরত পাননি বলে জানান।

একইভাবে আয়েশা আক্তার বাবার বাড়ির সম্পদ বিক্রি করে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছেন। প্রবাসী স্বামীর জমানো ৮১ লাখ টাকা দিয়েছেন মাহমুদা রহমান মলি। শম্পা ঘোষ দিয়েছেন সাড়ে ১২ লাখ টাকা। স্বামীর চিকিৎসার জন্য ২ লাখ টাকা চেয়েও পাননি শম্পা। বিধবা জুলেখা নিজের অলংকার বিক্রি করে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেন। ফাতেমার বিনিয়োগ ৭ লাখ টাকা। মেয়ের বিয়ের জন্য ২ লাখ টাকা চেয়েও তিনি পাননি। আবুল কাশেম পাটোয়ারী ব্যবসা ও স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা দেন আহমেদীয়া ফাইন্যান্সে। এম গিয়াস উদ্দিন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। এখন সবাই তাঁরা নিঃস্ব।