অপারেশন জ্যাকপটের চিত্রনাট্য নিয়ে টানাপোড়েন!

অপারেশন জ্যাকপটের চিত্রনাট্য নিয়ে টানাপোড়েন!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সফল গেরিলা অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে আত্মঘাতী অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তান ও তার মিত্র কয়েকটি দেশ থেকে অস্ত্র, খাদ্য ও তেল নিয়ে আসা ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পরিচিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ বিশ্বে অন্যতম সেরা নৌ-কমান্ডো অভিযান হিসেবে স্বীকৃত।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সেই ‘অপারেশেন জ্যাকপট’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ঢাকায় চিত্রধারণ (শুটিং) শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তেজগাঁওয়ে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও সার্জেন্ট জহুরুল হক  হলে (মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আল্লামা ইকবাল হল) প্রথম পর্যায়ের শুটিং সম্পন্ন হয়েছে। তবে এরই মধ্যে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি (বর্তমানে সদস্য) শাজাহান খান এমপি। ফলে এটির চিত্রনাট্য পুনঃপর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘চিত্রনাট্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন এসেছে; কিছু ডকুমেন্টস আছে। যেগুলো চিত্রনাট্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। ইতিহাসের কোনো ব্যত্যয় যাতে না হয়, সে জন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। প্রয়োজন হলে চিত্রনাট্য সংশোধন-সংযোজন করা হবে।’

জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শাজাহান খান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের মার্চে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমকে। পরে তিনি নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে কথা বলে চিত্রনাট্য চূড়ান্ত করেন। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিনেমাটি নির্মাণের জন্য ৩০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান (ডিপিপি) পাঠানো হয়। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পরিকল্পনাটি গ্রহণ না করে প্রস্তাবনাটি পুনর্মূল্যায়নের জন্য চিঠি পাঠায় চট্টগ্রাম বন্দরকে। এক পর্যায়ে ওই প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ধারাবাহিকতায় অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চলচ্চিত্রটি নির্মাণে ২০২২ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তখন গিয়াসউদ্দিন সেলিমের প্রতিষ্ঠানসহ পাঁচটি প্রোডাকশন হাউস প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়। তবে নির্বাচিত হয় কিবরীয়া ফিল্মসের প্রকল্পটি। এর আওতায় গত ৭ জানুয়ারি চলচ্চিত্রটির শুটিং শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নজরে আসার পর চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর কাছে অনুযোগ করেন শাজাহান খান এমপি, যা নিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সভা  হয়।

সভা সূত্রে জানা গেছে, চিত্রনাট্যের সামালোচনা করে শাজাহান খান বলেন, নৌ মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে চিত্রপরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমকে চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ৪৭ জন নৌ-কমান্ডোর সাক্ষাৎকার নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। তবে এখন আরেকটি চিত্রনাট্য নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। একই ঘটনায় দুটি চিত্রনাট্য হতে পারে না। এ সময় বৈঠকে উপস্থিত ছবিটির অন্যতম পরিচালক ভারতের রাজীব কুমার বলেন, অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের চারটি বন্দরে সংঘটিত হয়েছে। আলাদা চিত্রনাট্য হতে পারে। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আলোচ্য দুটি চিত্রনাট্য মিলিয়ে (পর্যালোচনা) পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত দেন। এর আলোকে চিত্রনাট্য পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন অপারেশন জ্যাকপটে চিত্রনাট্য রচনা করেছেন কাশেম আলী দুলাল।

চলচ্চিত্রটির শুটিং প্রসঙ্গে পরিচালক দেলোয়ার জানান ঝন্টু বলেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি থেকে শুটিং শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে এফডিসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতা ও প্রেক্ষাপটের চিত্র ধারণ করা হয়েছে। চলতি মাসে পরবর্তী শুটিংয়ের প্রস্তুতি চলছে।’

চলচ্চিত্রটির প্রযোজক স্বপন চৌধুরী বলেন, ‘কার্যাদেশের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজ পেয়েছি। নৌ-কমান্ডো অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা চিত্রনাট্য পর্যালোচনার পর স্বাক্ষর করে দিয়েছেন, যা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। এর আলোকেই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি কোনো ক্ষোভ থেকে চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ বাধাগ্রস্ত করে, সেটি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু চিত্রনাট্যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। আর এ ক্ষেত্রে কোনো সংশোধন-সংযোজন করতে হলেও নৌ কমান্ডোদের মতের ভিত্তিতেই হতে হবে। অপারেশন জ্যাকপট কোনও গল্প নয়, এটি ইতিহাসের দলিল। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই পুরো বিষয়টি সেভাবে বিবেচনা করতে হবে।’

এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনিয়মের মাধ্যমে কিবরীয়া ফিল্মসকে অপারেশন জ্যাকটপ নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চলচ্চিত্রকার গিয়াসউদ্দিন সেলিম। তিনি বলেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তিনিই প্রথম অপারেশন জ্যাকপটের চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। তাতে সরকারের কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই চিত্রনাট্য পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে অন্তত ১০টি বৈঠক হয়েছে। মন্ত্রণালয় তাঁর চিত্রনাট্য ব্যবহার করবে বলে তাঁকে দিয়ে দেড় বছর কাজ করিয়েছে। কিন্তু কথিত দরপত্রের নামে অন্য প্রতিষ্ঠানকে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গৃহীত চিত্রনাট্যে ত্রুটি আছে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাদের চিত্রনাট্য দেখিনি। আর যার যার চিত্রনাট্য ভিন্ন হবে– এটাই স্বাভাবিক। সরকার তাঁর চিত্রনাট্য গ্রহণ না করলে তিনি নিজেই ওই চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন।’

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, চলচ্চিত্রটির পরিচালক হিসেবে থাকছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ও কলকাতার রাজীব কুমার। বাজেট ধরা হয়েছে ২১ কোটি টাকা। ছবিতে ৮০ জনের বেশি অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করবেন। এর মধ্যে মুখ্য চরিত্রগুলোয় থাকবেন অনন্ত জলিল, রোশান, ইমন, নিরব, শিপন মিত্র, সাঞ্জু জন, জয় চৌধুরী ও আমান রেজা। এ ছাড়া থাকছেন মিশা সওদাগর, আহমেদ শরীফ, ইলিয়াস কাঞ্চন, ডন, ড্যানি সিডাকসহ আরও অনেকে।