২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত লুটপাট চালান পি কে

২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত লুটপাট চালান পি কে

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে (আইএলএফএসএল) লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন ঋণ জালিয়াতির মূল হোতা বর্তমানে ভারতে কারাবন্দি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মাধ্যমে ৩ হাজার ১২৯ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৬৮টি হিসাবের ঋণ স্থিতি ২ হাজার ৯৫৫ দশমিক ২৫ কোটি টাকা দীর্ঘদিন অনাদায়িভাবে পড়ে আছে। এ টাকা নামে-বেনামে প্রকৃতপক্ষে প্রশান্ত কুমার হালদার গংয়ের কাছে গিয়েছে বলে বিএফআইইউর অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।

এ ছাড়া ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনের মাধ্যমে পি কে হালদার গংয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে স্থানান্তরিত অর্থের স্থিতি রয়েছে আরও ১৭৪ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। এই মোট ৩ হাজার ১২৯ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে। এ আত্মসাতের জন্য সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএলএফএসএলের ৭ হাজার ৮১০ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কলমানি হিসাবে ৫৩ দশমিক ১১ কোটি টাকা, ট্রেজারি লাইনে ১৬৭ দশমিক ৩৯ কোটি, মেয়াদি আমানতে ১ হাজার ৩২ দশমিক ২৫ কোটি ও মেয়াদি ঋণে ৮৪২ দশমিক ৫১ কোটি টাকা।

এ ছাড়া ৩ হাজার ১৬০ জন ব্যক্তি ও ৯৯৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত হিসাবে ১ হাজার ৫৮৯ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। মোট ৩ হাজার ৬৮৫ দশমিক ১২ কোটি টাকা গ্রহণ করে বছরের পর বছর ধরে অপরিশোধিত অবস্থায় আটকে থাকায় মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হয়েছে। এসব আমানতকারীর পাওনা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শেয়ার বিক্রি করতে করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের অধিকাংশ পুরোনো শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিরা পরিচালনা পর্ষদ থেকে চলে যান। তাদের জায়গায় ২০১৫ সালেই শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নেচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে চারটি কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদে অধিকাংশ পরিচালকের পদ লাভ করে। নিউটেকের শুরু থেকেই বাসুদেব ব্যানার্জি ও তার স্ত্রী পাপিয়া ব্যানার্জি ১০ হাজারটি করে শেয়ারের মালিক ছিলেন।

২০১৫ সালেই নিউটেকের পক্ষে এমএ হাশেম, পাপিয়া ব্যানার্জি, নাসিম আনোয়ার আইএলএফএসএলের পরিচালক নিযুক্ত হন। এ বাসুদেব ব্যানার্জি ও পাপিয়া ব্যানার্জিকে বহুল আলোচিত ঋণ জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী হিসেবে এরই মধ্যে দুদক ও বিএফআইইউ চিহ্নিত করেছে। নেচার এন্টারপ্রাইজের এমডি মো. নওশেরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মমতাজ বেগমও একই সময়ে আইএলএফএসএলের পরিচালক নিযুক্ত হন। এ দুজনও পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী।

হাল ইন্টারন্যাশনালের মালিক-পরিচালকদের মধ্যে যাদের নাম প্রতিবেদনে এসেছে তারা হলেন—অবন্তিকা বড়াল, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, মৈত্রেয়ী রানী বেপারী ও সুস্মিতা সাহা। একপর্যায়ে ২০১৬ সালে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে এমএ হাশেমকে আইএলএফএসএলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

ওয়ালেস বাংলাদেশ লি. ছাড়া বাকি সব পুরোনো করপোরেট শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান চলে যায় ২০১৫ সালে। তখন পি কে হালদার গং তাদের বানানো নামসর্বস্ব কাগুজে চারটি নতুন কোম্পানির মনোনীত ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে মোট সাতজনকে অন্তর্ভুক্ত করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেয়। অতঃপর তারা আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিবর্তে নিজেদের বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হককে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।

এ ছাড়া নিজেদের বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ জাহরুল আলম এবং নুরুজ্জামানকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। চেয়ারম্যান ও পরিচালকসহ মোট ৯ সদস্য এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদে একছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর একটি কোম্পানি ম্যাটারে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত পি কে হালদার গংয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে আইএলএফএসএল। নিয়ন্ত্রণে রেখে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লুটপাট চালায় পি কে হালদার গং।