সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা : আমার বুকের ধনরে ছাড়া আমি বাঁচমু না।

সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা : আমার বুকের ধনরে ছাড়া আমি বাঁচমু না।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; সিরাজগঞ্জ : ‘আমার উৎপল কনে গেলো। ও উৎপল। তুই কনে গেলি। আমার বুকের ধনরে ছাড়া আমি বাঁচমু না। তোমরা আমার ব্যাটাক আইন্যা দেও।’

ঢাকার সাভারের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারের মৃত্যুতে মা অশীতিপর গীতা রানীর আহাজারি থামছেই না। সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশিরাও ভেঙে পড়ছেন কান্নায়।

সোমবার (২৭ জুন) বিকেলে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামে উৎপল কুমারের বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। সাভারের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্র তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারধরের শিকার হন তিনি। সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (২৭ জুন) ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।

উৎপল সরকারের মা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘প্রতি রাইতেই আমার ব্যাটা ফোন কইরছে। আমগোরে খবর লিছে। এহুন শুনি ছেলে নাই...।’ কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ মা গীতা রানী বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন।

উৎপলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী মলি রানী সরকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, উৎপল কুমারের মরদেহ ঢাকার সাভার থেকে রাত ৯টার দিকে গ্রামের বাড়িতে আসার কথা রয়েছে। রাতেই পার্শ্ববর্তী লাহিড়ী মোহনপুর শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্যের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

দেবরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে মলি রানী সরকার বলেন, শিক্ষার্থীদের শাসন করায় যদি শিক্ষককে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাহলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আর শৃঙ্খলা থাকবে না। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে।

প্রভাষক উৎপল কুমারের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসছেন তাঁর বড় ভাই অসীম কুমার। মুঠোফোনে তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘আমরা পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে উৎপল সবার ছোট। ও আমার মায়ের অতি আদরের সন্তান। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। আমার আদরের ভাইকে শিক্ষকতা করতে যদি জীবন দিতে হয়, তবে এর চাইতে দুঃখের, বেদনার আর কী হতে পারে? আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’

উৎপল কুমার সরকার উল্লাপাড়া উপজেলার এলংজানী গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁকে মারধরের অভিযোগ ওঠা শিক্ষার্থীর (১৬) বাড়ি আশুলিয়ায়। সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণির ছাত্র।

নিহত শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও কলেজে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে খেলা চলাকালে দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিত শিক্ষক উৎপল সরকারের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে ওই ছাত্র শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে এবং পরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। 

এ ছাড়া স্টাম্পের সুচালো অংশ দিয়ে পেটের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। পরে শিক্ষকেরা এগিয়ে গেলে ওই ছাত্র সেখান থেকে সটকে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় উৎপল সরকারকে প্রথমে আশুলিয়া নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়। আঘাত গুরুতর হওয়ায় সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ সোমবার ভোরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, অনেকে তাঁকে জানিয়েছেন, দুপুরে মাঠে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলাকালে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিক্ষক উৎপল সরকার। এ সময় দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে তাঁকে মারধর করে। উৎপল সরকার শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় তিনি শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেন। কেনো ওই ছাত্র এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি এখনো কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না।

নিহত উৎপলের ভাই অসীম কুমার সরকার বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, তাঁর ভাই শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি দেখতেন। দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় তাকে বোঝালেও সে সংশোধন হয় নি। উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে স্টাম্প দিয়ে তাঁর ভাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।