শিক্ষক শংকর দেবনাথ : আমি এখন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত।

শিক্ষক শংকর দেবনাথ : আমি এখন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত।

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ২০২০ সালে নির্যাতনের শিকার হওয়া কুমিল্লার মুরাদনগরের স্কুল শিক্ষক শংকর দেবনাথ বলেন, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব তুলে তাঁর বাড়িঘর, স্কুল ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে সব ধুলায় মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন ‘আমি ও আমার পরিবার প্রাণে বেঁচে গেলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে জামিনে এখন স্বদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করছি। আমি এখন নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত।’

‘শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। ওয়েবিনারে আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী বক্তব্য দেন। সোমবার (১৮ জুলাই) বিকেলে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। 

২০২০ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শংকর দেবনাথ আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে শিক্ষাঙ্গনের সাম্প্রদায়িকতার নৃশংস রূপ দেখে আমার শিক্ষকতা পেশার শখ মিটে যাচ্ছে। আমার মনোবল দিন দিন ভেঙে পড়ছে।’ 

শিক্ষামন্ত্রীর কাছে মামলা থেকে মুক্তি কামনা করে শংকর দেবনাথ বলেন, না হলে আত্মহনন ছাড়া তিনি আর গত্যন্তর দেখছেন না।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আক্রান্ত হওয়া আরেক শিক্ষক মুন্সীগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল মনে করেন, এসব ঘটনার পেছনে অতি অর্থলোভী নিম্নমানের কিছু শিক্ষকের ভূমিকাও রয়েছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে অন্তত দুই-তিন মাস পরপর অভিভাবক সমাবেশ ডাকা, বিজ্ঞান শিক্ষকের জোগান বাড়ানো এবং মাঝেমধ্যে প্রশাসনের মহড়া থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জয়দেব চন্দ্র শীল তাঁর ওপর হওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, কারাগারেও তিনি নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। 

তিনি বলেন, মামলার খরচ বহন করতে গিয়ে তাঁর পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত এর সমাধান চান। সুনামগঞ্জের ঝুমন দাসও তাঁর ওপর হওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শোনার পর বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘ঘটনাগুলো জানতাম, পত্রপত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু এখন যখন নিজের মুখ থেকে শুনেছি, তখন আমার বুকটা ভেঙে যায়। আমি তাঁদের বলতে চাই, আমরা ও আপনারা একই দেশের মানুষ। আমরা ও আপনারা যদি সমানভাবে বেঁচে থাকতে না পারি, তাহলে আমাদেরও আসলে বেঁচে থাকায় কোনও আনন্দ নেই।’ 

তিনি বলেন, ‘আসলে এ ধরনের দেশ তো আমরা কখনো চাই নি।’

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের ওপর হওয়া নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটা শুধু লজ্জাজনক ও দুঃখজনক ঘটনা নয়, মর্মান্তিক। তিনি মনে করেন এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সবই পরিকল্পিত। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

এ সময় ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দেন ডা. দীপু মনি।

ওয়েবিনারে সূচনা বক্তব্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, গত কয়েক বছরে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো ও শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। যার একটি উদাহরণ হলো, হেফাজতে ইসলামের দাবির কারণে ২০১৭ সালে স্কুল পাঠ্যসূচিতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপর দেখা গেছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগে হিন্দু ছাত্র ও শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের ঘটনাবলি। 

তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।

সম্প্রতি আক্রমণের শিকার হওয়া অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। ইতিমধ্যে সমাজটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন রাষ্ট্রটি হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্র চাইলে মৌলবাদকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস, সম্প্রীতি বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মামুন আল মাহতাব, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল প্রমুখ।