যুদ্ধের অপারেশন : দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

যুদ্ধের অপারেশন : দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

বীর মুক্তিযোদ্ধার কলাম :: ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সাল। ২৫ মার্চ’৭১ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক নৃশংস আক্রমণে শুরু হয় বাঙালিদের উপর জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী নৃশংসতম অপরাধ। বাঙালি সৈন্য ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য বাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ২৬ মার্চ’৭১ থেকে শুরু হয় হানাদার মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সকল বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, আনসার, অন্যান্য বাহিনী, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে। শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি গুটি কয়েক স্বাধীনতা বিরোধী। আমি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১২ ডিসেম্বর’৭১ জামিরতা গ্রামের অধিবাসী বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর নিয়ন্ত্রণাধীন আমাদের গ্রুপটি ছিলো সৈয়দপুর গ্রামের কালা চাঁদ চক্রবর্ত্তী ও অন্যান্যদের বাড়িতে। ১৩ ডিসেম্বর’৭১ ছিলো আমাদের শেষ রণাঙ্গনের যুদ্ধ। যুদ্ধটি ছিলো ধীতপুর গ্রামে।

১. ধীতপুর যুদ্ধ : ধীতপুর যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ১৩ ডিসেম্বর’৭১ সংবাদ পেলাম পাকি হানাদার সৈন্যরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুইজন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়েছে। মালিপাড়ার কাছের গ্রামের ২/৩ জন যুবক এসে সংবাদ দিলো কিছু পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পাকি হানাদারদের অনুসরণ করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। সংবাদ পেয়ে শাহজাদপুুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোও আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলো। পাকি হানাদারেরা ছিলো ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মূলাক্ষেত থেকে মূলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাঁচা মূলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধী। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি করলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিলাম। ওদের উপর গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। ওরাও ওয়াপদা বাধের পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিলো। এক ঘণ্টারও অধিক সময় গুলি-পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে শাহজাদপুর উপজেলার সিরাজুল ইসলামের গ্রুপ ও অন্যান্য গ্রুপ, বেড়া উপজেলার এস আমির হোসেনের গ্রুপ ও অন্যান্য গ্রুপ। শাহজাদপুর থানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। অন্ধকার হয়ে এলো। হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করলাম। সারারাত আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। 

আমাদের গ্রুপটি ছিলো বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীর কমান্ডনাধীন। আমার বামপাশে এলএমজি চালাচ্ছিলেন কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চী স্যার। আমার ডানপাশে থ্রি নট থ্রি চালাচ্ছিলেন আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল, তাঁর ডানপাশে আমার গ্রুপের নজরুল ইসলাম, শামসুল হক ও অন্যান্যরা স্টেনগান ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলেন। যুদ্ধটি ছিলো ভীষণ ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ। তথাকথিত হিংস্র পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ। হয় যুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে, অন্যথায় সবার জীবন যাবে। আমাদের গ্রুপের ডানদিকেই ছিলো বেড়ার এম আমির হোসেনের গ্রুপ। তুমুল যুদ্ধ। দুটি গুলি এসে আমার হেলমেটে লাগলো। এস এম আমির হোসেন সাহেবের গ্রুপের আব্দুল খালেক ও আমজাদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হলো। দুইজনই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। গুলিবিদ্ধ স্থান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। তাঁরা দুইজনই বার বার ‘পানি পানি’ বলছিলো। তাঁদের অবস্থা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই গুলি করা বন্ধ করা যাবে না। আমরা সবাই গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। আমি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি চালাচ্ছি। একটি হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করলাম। এর মধ্যে সন্ধ্যা ও অন্ধকার নেমে এলো। রাতে ধীতপুর বিশ্রামাগার থেকে মাঝে মাঝে ২/১ টা করে গুলি আসছিলো। ওদের গুলির প্রেক্ষিতে আমরাও ২/১ টা করে গুলি করছিলাম। ভোরে ফর্সা হলে আমাদের কমান্ডার বরীন্দ্রনাথ বাগ্চী ও বেড়ার কমান্ডার এস এম আমির হোসেন ও অন্যান্যরা ক্রোলিং করে ধীতপুর রেস্ট হাউসে এগিয়ে গেলেন। রেস্ট হাউসে গিয়ে দেখা গেলো দুজন রাজাকার সারারাত কভারিং ফায়ার করেছে। কমান্ড করে রাজাকার দুজনকে স্যারেন্ডার করালেন। তারা দুইজন আত্মসমর্পণ করলো। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে নেওয়া হলো। তাদের কাছ থেকে জানা গেলো রাত ১১টার দিকে হানাদারেরা ক্রোলিং করে নিরাপদ দূরত্বে এসে হেঁটে বেড়া নদী পার হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে পালিয়েছে। পরে জানা গেলো পাকি হানাদারেরা বেড়া ঘাটে গিয়ে ভেড়াকোলা গ্রামের হলদারদের নৌকায় নদী পাড় হয়ে নগরবাড়ি ঘাট হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে মার্চ করেছে। ধীতপুরের যুদ্ধে বেড়ার এস এম আমির হোসেনের গ্রুপের বৃশালিকা গ্রামের বেড়া বিবি হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের আমজাদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে দুইজনই শহিদ হয়েছেন এবং আমাদের অন্যান্য গ্রুপের ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছেন। স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি লেগে ওয়াপদা বাধের উপর মারা গিয়েছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাইস্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে বিজয় অর্জিত হয়।

২) বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ : বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। অক্টোবর, ১৯৭১ সালের শেষের দিকে আমরা এই থানা আক্রমণ করেছিলাম। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম এ মান্নান স্যার। কমান্ডার স্যার এবং আরও ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণ করলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি গ্রামের এক বাড়ির শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করলেন। আমাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো : কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রুপটি থানা আক্রমণ করবে, অন্য গ্রুপটি রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রুপে থেকে থানা আক্রমণ যুদ্ধে অংশ নিলাম। রাত ৯টায় বানিয়া গাতি থেকে যাত্রা করলাম। থানার কাছে গিয়ে দু গ্রুপ টার্গেটের উদ্দেশ্যে ভাগ হয়ে গেলাম। নিদিষ্ট সময়ে রাত ১২টায় একযোগে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হলো। পরিকল্পনা মোতাবেক থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রোলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেললো। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমাদের কমান্ডার স্যার কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা সবাই একযোগে গুলি করলাম। একঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ চললো। ভয়াবহ যুদ্ধ। আমার মাথায় হেলমেট। দুইটি গুলি এসে হেলমেটে লাগলো। আমার ডান পাশে আমার কমান্ডার। হয় বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোনও পথ নাই। বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধের এক সময়ে কমান্ডার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেবেশ মাথা তুলো না, গুলি চালিয়ে যাও।’ 

আমাদের বৃষ্টির মতো গুলিতে থানার বিহারী পুলিশ ও রাজাকার থানার পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর নদীতে থাকা একটি লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে চলে গেলো। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো।

আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমরা থানার মালখানা থেকে সকল গোলাবারুদ নিলাম। থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত বেঁধে ধরে নিয়ে এলাম। রাজাকাররা যাতে আমাদের শেল্টার চিনতে না পারে, সেজন্য তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেলো। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করা দলটিও এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলো। বিজয়ী হয়ে চলে এলাম। 

পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার ও রাজাকার এসে থানার আশেপাশে আগুন দিয়েছিলো এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিলো। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে আমরা ২ জন রাজাকারকে ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেঁধে আমাদের শেল্টারের ও আলাদা রুমে রেখেছিলাম। তাদেরকে চোখ বেঁধে পাশের রুমে রাখা হয়েছিলো। আমি কমান্ডার স্যারের অনুমতি নিয়ে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। তাদেরকে রাজাকার হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম ও শুনলাম। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে মনে হলো, ওরা সহজ সরল ও অভাবী মানুষ। ওদের বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা আছে। পিচ কমিটির লোকদের কথায় বিশ্বাস করে ওরা রাজাকার হয়েছে। ওরা মনে করেছিলো, এটা একটা চাকুরি। উপার্জন করে সংসার পরিচালনার জন্য ওরা রাজাকার হয়েছে। তারা বললো, আমরা কাউকে কোনও অত্যাচার করি নাই। কোনও বাড়িঘর লুটতরাজ করি নাই। পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে এসে কোনও গণহত্যা করি নাই। কোনও বাড়িতে আগুন দিই নাই...। তাদের কথায় আমার মায়া হলো। আমি তাদের চোখ বাঁধা খুলে দিলাম। তাদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝালাম। রাতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারকে অনুরোধ করে রাজাকার দুইজনকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।

৩) কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য অ্যাম্বুস : কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই অ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম এ মান্নান স্যার। ৪ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে আমাদের গ্রুপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এমএনএ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য অ্যাম্বুস করেছিলাম। কালিয়া হরিপুর যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমার রণাঙ্গনের সাথী জনাব আব্দুল হামিদ তালুকদার সাহেব বললেন, ‘দেবেশ, মানিকাচর তোমার বাবা-মাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করেছি। সবাই ভালো আছেন। তোমার রেশন ও পকেট মানির টাকা তোমার আব্বার হাতে দিয়ে এসেছি। তোমার এক ভাই আমার সঙ্গে এসেছে, তাঁকে শমেসপুর গ্রামে এক বাড়িতে রেখে এসেছি। আগামীকাল সে তোমার কাছে আসবে।’ 

ওই অ্যাম্বুস যুদ্ধ হয় নাই। কমান্ডার স্যার স্ক্রোলিং করে রেললাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে এসেছিলেন। তথ্য ছিলো ঈশ্বরদী থেকে পাকি হানাদার নিয়ে একটি ট্রেন সিরাজগঞ্জ যাবে। কমান্ডার স্যার ট্রেনটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারি। টর্চলাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলিশিয়া ও রাজাকারেরা স্টেশনে টহল দিচ্ছিলো। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। মাইনটি ওদের নজরে পড়লো। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের পজিশনে রেডি থাকতে বললো। আমাদের দিকে টর্চলাইট মেরে মেরে উর্দুতে বকাবকি করতে থাকলো। 

ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জগামী পাকি হানাদারবাহী ট্রেন এলো। পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিলো। তারা স্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিলো। ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে থাকলো। মাইনের বৈদ্যুতিক তার বিছিন্ন হয়ে পরায় আমাদের মাইনটি ব্রাস্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। আমরা উইথড্র হয়ে কমান্ডার স্যারের বাড়ি বেলকুচি থানার তামাই গ্রামে এলাম। পরেরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুর ও পাশের কয়েকটি গ্রামের কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলো। কিছু লোকের উপর নির্যাতন চালিয়েছিলো। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন অ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশকিছু যুবককে আমাদের গ্রুপে ভর্তি করা হলো। এতো বড় প্লাটুন এক শেল্টারে, শেল্টার নেওয়া সমস্যা হলো। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীকে কমান্ডার করে আমাদের ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিলেন।

৪) কল্যাণপুর যুদ্ধ : কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। ৫ নভেম্বর, ১৯৭১ এ কল্যাণপুর গ্রামে একটি যুদ্ধ হয়েছিলো। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১ জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেঁটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকে ও হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি-প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলথ্রু মারলাম। একজন করে করে আমাদের অবস্থান পাহারা দিতে থাকলাম। অন্যান্যরা কেউ কেউ ঘুম বা রেস্টে থাকলাম। কল্যাণপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারণা ছিলো, এই গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমাদেরকে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলিশিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যাণপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান হলো এই দলে ৫জন মিলিশিয়া ও ৪ জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যাণপুরে রাস্তার ধারে বাঁশঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারেরা  আসছিলো। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা একযোগে গুলি করা শুরু করলাম। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তরপাশে পজিশন নিলো। ওরাও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশপাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এক ঘণ্টারও অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চললো। তারপর পাকি হানাদারেরা পিছিয়ে গেলো। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর হেঁটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মুক্তি শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে এই শেল্টারে আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। কয়েকদিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে লাগলাম।

জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে আমাদের জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়। জাতির পিতা ওইদিনই লাহোর থেকে সকালে বিমানে যাত্রা করে বিকেলে ইংল্যান্ডের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাঙালিদের জাতির পিতাকে বিশেষ সম্মান দেখিয়ে সংবর্ধনা দেন। জাতির পিতা ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশদের বিশেষ বিমানযোগে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাংলাদেশে আসার পথে ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ভারতে যাত্রাবিরতি করেন। তারপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে আসলেন। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি পদের ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রুপ ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ এ (রোববার) সিরাজগঞ্জ সদরের বাসায় অস্ত্র জমা নেওয়ার ক্যাম্পে অস্ত্র ও গোলাবারুদ্ধ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করলাম। সরকারের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্প করা হলো। আমি ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে চলে এলাম। কয়েকদিন পর রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল এর কাছ থেকে অষ্টম শ্রেণীর অটোপাশের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম।

লেখক : জনাব দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।

ঠিকানা : বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, পিতা : দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতা : নিলীমা রানী সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর : রতন কান্দি, ইউনিয়ন : হাবিবুল্লাহনগর, উপজেলা : শাহজাদপুর, জেলা : সিরাজগঞ্জ। গেজেট নম্বর : বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ : ১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ : এফএফ নম্বর : ৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জেলাভিত্তিক : ১৬১১, উপজেলা ভিত্তিক : ১৫১, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নম্বর : ০১৮৮০০০১৪১১।