ময়লার গাড়ি থেকে দিনে অন্তত ১৭ লিটার তেল চুরি করেন এক চালক!

ডন প্রতিবেদন : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় দুইজন নিহতের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ঘটনায় জড়িত চালকদের কেউই পেশাদার বা করপোরেশন নির্ধারিত চালক নয়। করপোরেশনের দুই-একজনের যোগসাজশে ময়লাবাহী গাড়ি চালাতেন তারা, আর তাদের আয় বলতে ছিল তেল চুরির অর্থ। জড়িত চালকদের গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব জানায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়ার্কশপের সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেরসঙ্গেই তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। এ সুযোগে তারা ময়লাবাহী গাড়ি চালানোর সুযোগ পান। এজন্য তাদের কোনও বেতন ছিলো না, গাড়ির জন্য বরাদ্দ থেকে ১৭ থেকে ২০ লিটার তেল বিক্রি করাই ছিলো তাদের উপার্জনের উৎস। শনিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে র‌্যাবের কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে চালক রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পরে শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ওই গাড়ির মূলচালক হারুনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব-৩)। আর গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীর পান্থপথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় সংবাদকর্মী আহসান কবীর খান (৪৬) নিহত হন। এ ঘটনায় শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) চাঁদপুরে অভিযান চালিয়ে চালক হানিফ ওরফে ফটিককে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-২। র‍্যাব জানায়, ঘটনার দিন হানিফ পান্থপথ থেকে গাবতলীতে দুইবার ময়লা নিয়ে ডাম্পিং করেন। তৃতীয়বার যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেলকে চাপা দিলে আরোহী আহসান কবীর নিহত হন। ঘটনার পর ভয় পেয়ে হানিফ ও তার সহকারী কামরুল গাবতলী পালিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে চাঁদপুরে নানার বাড়িতে আত্মগোপনে যান হানিফ। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-২ হানিফকে ধরতে দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালায়। এরপর চাঁদপুর থেকে হানিফকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। গ্রেপ্তার হানিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‍্যাব জানায়, তিনি গত ছয়-সাত বছর ধরে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্কশপে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ডিএনসিসির বেতনভুক্ত বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীও না। প্রতিদিন মেকারের সহকারী হিসেবে কাজ করলে কেউ যা বকশিস দিতো, সেটাই তার একমাত্র আয় ছিলো। এরমধ্যে গত তিন বছর ধরেই তিনি ডিএনসিসির বিভিন্ন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ২০১৯ সালে নিজে হালকা যানবাহন পরিচালনার লাইসেন্স পেলেও ময়লাবাহী ট্রাকের মতো ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিলো না। এরপরেও গত প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি এই ময়লাবাহী ভারী ট্রাক চালাতেন। গত কয়েক বছরে সিটি করপোরেশনের কয়েকজনেরসঙ্গে তার সখ্যতা হয়। সেই সখ্যতা থেকেই তিনি গাড়ি চালানোর জন্য পেয়ে যান। এজন্য তিনি কোনও মাসিক বা দৈনিক হাজিরার বেতন পেতেন না। তবে গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল থেকে প্রতিদিন ১৭ থেকে ২০ লিটার তেল ‘বাঁচাতে’ সক্ষম হতেন তিনি। সেই তেল বিক্রির অর্থই ছিলো তাঁর আয়ের উৎস। র‍্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, হানিফ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের কাছে দুই-একজনের কথা বলেছে। যাদেরসঙ্গে সখ্যতার জেরে সে গাড়িটি চালানোর জন্য পায়। এরমধ্যে ডিএনসিসির স্থায়ী কর্মী এবং মাস্টাররোলের কর্মীও রয়েছে। আমরা বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করতে ডিএনসিসিরসঙ্গে আলোচনা করবো। তারা নিশ্চয়ই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ‘এ ছাড়া, এ ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেপ্তার হানিফকে থানায় সোপর্দ করা হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও নিশ্চই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবেন।’ অন্যদিকে, নটরডেম শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়িচালক গ্রেপ্তার হারুনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হারুন গত দেড় বছর ধরে গাড়িটি চালালেও তার নামে গাড়িটি বরাদ্দ নয়। তিনিও মূল চালক নন, তার কাছে আমরা লাইসেন্স পাই নি। ঘটনার দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন দাবি করেছেন। তাই রাসেলকে সেদিন চালাতে দিয়েছিলেন বলেই জানিয়েছেন। কিন্তু সেদিন ছাড়াও রাসেলকে মাঝেমধ্যে গাড়ি চালাতে দিতেন হারুন। রাসেল যখন অ্যাকসিডেন্ট করে, তখন অন্যদের মাধ্যমে খবর পান হারুন। পরে তিনি ভয় পেয়ে পালিয়ে যান। তিনিও গাড়ি চালানোর জন্য ডিএসসিসির কাছ থেকে কোনও বেতন পেতেন না। বেঁচে যাওয়া তেল বিক্রিই তার একমাত্র আয় ছিলো। এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররা জানে না গাড়িগুলো কার নামে বরাদ্দ। তবে হানিফের কাছ থেকে আমরা দুই-একজনের নাম পেয়েছি। বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাবো। তারা হয়তো এ বিষয়ে বলতে পারবে। তদন্ত কর্মকর্তাও তদন্ত করবে। আশা করছি, যে ধরনের অপসংস্কৃতি চলে আসছে, আমরা এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।