মাসুদে ‘ডুবছে’ রূপালী ব্যাংক

মাসুদে ‘ডুবছে’ রূপালী ব্যাংক
ডন প্রতিবেদন : ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। আর এই এমডির কারণেই ‘ডুবছে’ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের এ ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম, এলসি (আমদানির ঋণপত্র) জালিয়াতি, ঋণ জালিয়াতি, যোগসাজশ করে পরিচালকদের ঋণ প্রদান এবং সেই অর্থ আর ফেরত না আসা, শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের বাড়তি সুবিধা প্রদান- বিপরীতে কোনও অর্থ ফেরত না আসা, খেলাপি ঋণ লক্ষ্য অনুযায়ী আদায়ে ব্যর্থ হওয়া এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে কর্মকর্তাদের বড় অংকের অর্থ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের বিরুদ্ধে। সার্বিক ব্যাপারে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের মুঠোফোনে (০১৭১৩৪৮০১০…) মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) বেশ কয়েকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে রূপালী ব্যাংকের আদায় করার লক্ষ্য ছিলো ২২০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি আদায় করতে সমর্থ হয়েছে মাত্র ৩৮ লাখ টাকা। এ অবস্থায় গেলো আগস্ট শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এমন ব্যর্থতা ছাড়াও গত জুনভিত্তিতে এর ফোর্সড লোনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির কথাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা কাগজ এবং ডনকে বলেন, ব্যাংকে অনিয়ম হয়েছে, তখনই বোঝা যায়, যখন ব্যাংকের অর্থ আর ফেরত আসে না। এসবক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে অনিয়ম করা হয় কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠান ঋণ নিলেও সেগুলো প্রভাব খাটিয়ে ফেরত দিতে চায় না; এক্ষেত্রে সরকারি দলের পরিচায় প্রদান করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে বেশি অনিয়ম হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। জানা গেছে, পণ্য আমদানির (এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংকগুলো। আর আমদানি করা পণ্য দেশে আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করার পর ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে থাকে। তবে গ্রাহক অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, সেই গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে থাকে। ওই অর্থে দেশি ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করে। এভাবে ব্যাংকে গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন হয়, যা মূলত আমদানির বিপরীতেই সৃষ্টি হয়। আর একে এলসি জালিয়াতিই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। জানা গেছে, রূপালী ব্যাংকে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্দিষ্ট কিছু শাখার মাধ্যমেই ঋণ বিতরণে জোর দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে অনিয়মের বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন শেষে রূপালী ব্যাংক বিতরণ করেছে ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। যারমধ্যে মাত্র ৫ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৬১ শতাংশ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা কাগজ এবং ডনকে বলেন, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মূলধন ঘাটতিতে পড়ে জনগণের অর্থ থেকে ঘাটতি পূরণ রূপালী ব্যাংকের ‘সাধারণ’ ঘটনা। এক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ লুটপাট হওয়ার কারণেই ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। জানা গেছে, ব্যাংকের তহবিল থেকে কর্মচারীদের আয়কর দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে রূপালী ব্যাংকে। আর ঋণ জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নামে মামলা এবং আটক যেনো এখানে নিত্যনৈমক্তিক ঘটনা। অনেকেই অবশ্য এটিকে জালিয়াতির জন্য ‘আইওয়াশই’ বলছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- ‘সাধারণ’ অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রশিক্ষণ, পদায়ন, গৃহ নির্মাণ ঋণ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুর্নীতি রূপালী ব্যাংকে চরমে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের নামে প্রমোদ ভ্রমণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের নামে তারিখ ছাড়া মোটা অংকের অর্থ অনুমোদনের নজিরও পাওয়া গেছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনিয়মের চিত্রে। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ব্যাংকিং খাতে কোনও অঙ্গসংগঠন না থাকলেও সরকার দলীয় অনুমোদিত সংগঠন বলে প্রভাব বিস্তার এখানে চরম দৃশ্যমান, যা ভাইয়া গ্রুপ নামে পরিচিত। আর এই ভাইয়া গ্রুপেরসঙ্গে মিলেমিশেই জালিয়াতিতে ‘ব্যস্ত’ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পাশাপাশি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ই-মেইল জালিয়াতি করে বরখাস্ত হওয়া কমকর্তা এবং শাখা ব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় গ্রাহকের এফডিআর (স্থায়ী আমানত) আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম-পরিচালক (টাস্কফোর্স সেল) মাহমুদুন নবী গত বছরের পহেলা জানুয়ারি রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি প্রদান করেন। ওই চিঠিতে সার্টিফিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও রূপালি ব্যাংকে চাকরি হওয়ার মতো ঘটনার কথা জানা যায়। চিঠিতে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে বিষয়টিতে রূপালী ব্যাংকের জবাব জানতে চেয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ব্যাংকটিতে ২০১৪ সালে জ্যেষ্ঠ অফিসার ও অফিসার পদের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৬০ জন কর্মকর্তা ভুয়া সনদ এবং নিয়োগ পরীক্ষায় মূল প্রার্থীদের বদলে ভাড়া করা চুক্তিভিত্তিক লোক দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পান। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওই নিয়োগ দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথি থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত উত্তরপত্র, নম্বর শিটসহ আনুষঙ্গিক তথ্যপত্র এরইমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যা বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আমলে করা হয়েছে বলেই দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র। আরও জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে রূপালী ব্যাংকের নিয়োগ দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত ১৫ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়। রূপালী ব্যাংক নিয়ে অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতি অনুসন্ধানে বাংলা কাগজ ও ডন আরও জানতে পেরেছে যে, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাঝেমধ্যেই মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের জন্য কয়েক লাখ টাকা অনুমোদন দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ৬ লাখ টাকার একটি তারিখবিহীন চেকের প্রতিলিপি বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনের হাতে এসেছে। এক্ষেত্রে ওই চেকের ট্রানজিট ডেবিটের ঘরে লেখা আছে ‘রূপালী ব্যাংক লি. ক্রীড়া পরিষদ, প্রধান কার্যালয়ের নোট মোতাবেক এবং মাননীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয়ের অনুমোদনক্রমে উক্ত টাকা দোয়া ও ইফতার মাহফিলের ব্যয় স্থানীয় কার্যালয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হলো।’ সূত্র আরও জানায়, আইবিপি (অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়), এলএটিআর (লোন এগেইনেস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট) এবং করপোরেট গ্যারান্টির মাধ্যমে ঋণ প্রদানে জালিয়াতি সাম্প্রতিক সময়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক (ইডি) সিরাজুল ইসলাম বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) দুপুরে বলেন, আমাদের যে কোনও যথাযথ নিয়ম না মানলে, সেটা অভিযোগ আকারে আমাদের কাছে আসতে পারে; ইনস্পেকশন আকারে বের হতে পারে কিংবা নোটিশ বা অন্যভাবেও আসতে পারে। আর সেটা যেভাবেই আসুক না কেনো, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আইন অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।