ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাস বিশ্ববাজারে : সমন্বয়ের ‘উদ্যোগ নেই’ দেশে।

ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাস বিশ্ববাজারে : সমন্বয়ের ‘উদ্যোগ নেই’ দেশে।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; চট্টগ্রাম : নভেল করোনাভাইরাসজনিত মহামারি শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অস্থিতিশীল করে তোলে বৈশ্বিক ভোজ্যতেলের বাজার। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী বুকিং বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে রমজান মাস থেকেই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে মত দিচ্ছিলেন ব্যবসায়ীরা। শেষ পর্যন্ত ঈদের পর বাড়ানো হয় সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম। এদিকে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক দাম আবার কমতে শুরু করেছে। তবে এর প্রেক্ষিতে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যটির দাম সমন্বয়ের কোনও উদ্যোগ নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে পাম অয়েলের টনপ্রতি বুকিং মূল্য ছিলো ১ হাজার ৬৮৩ ডলার, সয়াবিনের মূল্য ছিলো ১ হাজার ৯৪৮ ডলার। মে মাসের মাঝামাঝি পাম অয়েলের বুকিং মূল্য কমে নেমে আসে ১ হাজার ৪২৫ ডলারে এবং সয়াবিনের বুকিং মূল্য নেমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৩০ ডলারে। এ হিসেবে পাম অয়েলের বুকিং কমেছে ২ শ ডলারের কিছু বেশি আর সয়াবিনের বুকিং কমেছে প্রায় ১২০ ডলার। স্বাভাবিকভাবে ১ শ ডলারের বেশি দামের উত্থানে দেশীয় আমদানিকারকরা দাম সমন্বয়ের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ জানালেও দাম কমে যাওয়ার ১২ দিন পেরোলেও ব্যবসায়ী বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কারও তরফ থেকে কোনও উদ্যোগ দেখা যায় নি।

এর আগে ১১ মে রাজধানীতে আয়োজিত এক সভায় ১৫ দিন পরপর আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। সে সময় তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিদিন সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের দাম ওঠানামা করছে। অথচ দেশে এক-দেড় মাস পরপর দাম সমন্বয় করা হয়। এ কারণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৫ দিন পরপর ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করতে হবে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমাতে হবে, আর দাম বাড়লে বাড়াতে হবে।

এ ছাড়া সভায় আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে পরিশোধিত বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল আমদানি উন্মুক্ত করা; সান ফ্লাওয়ার, ক্যানোলাসহ সব ধরনের ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক ও কর প্রত্যাহারে সরকারের কাছে সুপারিশ করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

দেশের বাজারে এ মুহূর্তে ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল। বর্তমানে এসও (সাপ্লাই অর্ডার) পর্যায়ে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম অয়েল লেনদেন হচ্ছে ৬ হাজার ২০০ টাকায়, সুপার পাম অয়েল ৬ হাজার ৪ শ ও সয়াবিন লেনদেন হচ্ছে ৭ হাজার ১ শ টাকায়। এসও পর্যায়ে দাম কম থাকলেও পাইকারি (এসও দিয়ে মিলগেট থেকে সংগ্রহ করার পর খুচরা ক্রেতাদের ভোজ্যতেল ক্রয়মূল্য) পর্যায়ে পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি ৬ হাজার ৭ শ টাকা, সুপার পাম অয়েল ৬ হাজার ৮ শ ও সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ৫ শ টাকায়।

এ বিষয়ে টি কে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, এটা সত্যি যে, দেশে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পর বিশ্ববাজারে পণ্যটির বুকিং দর কমেছে। তবে টনপ্রতি ১ শ ডলার কমলেই সেটি স্থিতিশীল থাকছে না। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও সরবরাহ সঙ্কট পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। 

‘তা ছাড়া দেশে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও আমদানি খরচ বেড়ে স্বাভাবিকভাবেই দাম সমন্বয় হয়ে গিয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণের শর্ত হিসেবে ব্যবসায়ী কিংবা সরকার চাইলে এসব পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করে দাম পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত যে কোনও একটি পক্ষ নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনা করে প্রথম উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ মাসেই একবার দাম বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কমানোর প্রস্তাব আসবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংস্থাগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী দাম কমলেও এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম নতুন করে নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও পক্ষই তৎপর হয় নি বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পর বিশ্ববাজারে বুকিং দাম প্রতিদিনই কমছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দাম সমন্বয়ের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। সম্প্রতি পাইকারি বাজারগুলোয় ভোজ্যতেলের লেনদেন অনেক কমে গেছে। পাইকারি বাজারে লেনদেন কমে গেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোজ্যতেলের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়তে পারে। দাম বাড়ানোর মতোই বুকিং কমে যাওয়ায় নতুন করে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় জরুরি।

ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের কথা জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেল আমদানির হালনাগাদ তথ্য ও নথিপত্র আমাদের কাছে নিয়মিত বিরতিতে দেন। এখন পর্যন্ত দেশে প্রবেশ করা ভোজ্যতেলের দামের সঙ্গে বর্তমান দেশীয় বাজারমূল্যের সমন্বয়ের সুযোগ নেই। বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা কমেছে এটা সত্য, তবে সেটি প্রতিদিন ওঠানামার মধ্যেই থাকে। এর পরও আগামী সপ্তাহে ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক বাজার সংক্রান্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠাবে। সেটি দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো যে, দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে কিনা।

এদিকে ইতোমধ্যেই পামওয়েল রপ্তানির কথা জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া।